পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজসিংহ এই পত্রের উত্তরে বিক্রমসিংহ লিখিলেন, “আমি দুই হাজার অশ্বারোহী লইয়া আপনার নিকট যাইতেছি । ঘাট ছাড়িয়া দিবেন।” রাজসিংহ চঞ্চলকুমারীর মত সমস্ত বুঝিতে পারিলেন না । ভাবিলেন, “দুই হাজার মাত্র অশ্বরোহী লইয়া বিক্রম আমার কি করিবে ? আমি সতর্ক আছি ।” অতএব তিনি বিক্রমকে ঘাট ছাড়িয়া দিবার আদেশ প্রচার করিলেন । দ্বাদশ পরিচ্ছেদ অগ্নি পুনর্জলিত উদয়সাগরের তীরে ফিরিয়া আসিয়া, ঔরঙ্গজেব তথায় শিবিরস্থাপন ও রারিষাপন করিলেন । সৈনিক ও বাহনগণ খাইয়া বাচিল । তখন সিপাহীমহালে গান, গল্প এবং নানাবিধ রসিকতা আরম্ভ হইল। এক জন মোগল বলিল, “হিন্দুর রাজ্যে আসিয়াছি বলিয়া আমরা একাদশীর উপবাস করিয়াছিলাম।” শুনিয়া এক জন মোগলানী বলিল, “বাচিয়া আছ, তবু ভাল । আমরা মনে করিয়াছিলাম, তোমরা নাই—তাই আমরাও একাদশী করিয়াছিলাম " এক জন গায়িকা কতকগুলি সোঁখীন মোগলদিগের সম্মুখে গীত করিতে ছিল ; গায়িতে গায়িতে তাহার তাল কাটিয়া গেল । এক জন শ্রোতা জিজ্ঞাসা করিল, “বিবিজান ! এ কি হইল ? তাল কাটিল ষে ?” গায়িক বলিল, “আপনাদের ষে বীরপনা দেখিলাম, তাহাতে আর হিন্দুস্থানে থাকিতে সাহস হয় না । উড়িষ্যায় যাইব মনে করিয়াছি—তাই তাল কাটিতে শিখিতেছি।”—কেহ বা উদিপুরীর হরণ বৃত্তান্ত লইয়া দুঃখ করিতে লাগিল— কোন খয়েরখ হিন্দু সৈনিক রাবণকৃত সীতাহরণের সহিত তাহার তুলনা করিল—কেহ তাহার উত্তরে বলিল, “ৰাদশাহ এত বানর সঙ্গে আনিয়াছিল, তবু এ সীতার উদ্ধার হইল না কেন ?” কেহ বলিল, “আমরা সিপাহী—কাঠুরিয়া নহি, গাছ-কাটা বিদ্য৷ আমাদের নাই, তাই হারিলাম।” কেহ উত্তরে বলিল, “তোমাদের ধানকাটা পৰ্য্যন্ত বিদ্যা, তা গাছ কাটিবে কি ?” এইরূপ রঙ্গরহস্ত চলিতে লাগিল । এ দিকে বাদশাহ শিবিরের রঙমহালে প্রবেশ করিলে, জেব-উন্নিসা তাহার নিকট যুক্তকরে দাড়াইল । বাদশাহ জেব উন্নিসাকে বলিলেন, “তুমি যাহা করি য়াছ, তাহা ইচ্ছাপূৰ্ব্বক কর নাই, বুঝিতে পারিতেছি। ఫి& এ জন্য তোমাকে মার্জন করিলাম। কিন্তু সাবধান । বিবাহের কথা প্রকাশ না পায় ।” তার পর উদিপুরী বেগমের সঙ্গে বাদশাহ সাক্ষাৎ করিলেন । উদিপুরী তাহার অপমানের কথা আদ্যোপাস্ত সমস্ত বলিল । দশটা বাড়াইয়া বলিল, ইহা বলা বাহুল্য । ঔরঙ্গজেব শুনিয়া অভ্যস্ত ক্রুদ্ধ ও বিমর্ষ হইলেন । পরদিন দরবারে বধিয়া, আম-দরকার খুলিবার আগে, নিভৃতে মবারককে ডাকিয়া বাদশাহ বলিলেন, “এক্ষণে তোমার সকল অপরাধ আমি মার্জন করিলাম। কেন না, তুমি আমার জামাত । আমার জামাতাকে নীচপদে নিযুক্ত রাখিতে পারি না । অতএব তোমাকে দুই হাজারের মনসবদার করিলাম, পরওয়ানা আজি বাহির হইবে । কিন্তু এক্ষণে তোমার এখানে থাকা হইতে পারিতেছে না । কারণ, শাহজাদা আকৃবর্বর পর্বতমধ্যে আমার স্যায় জালে পড়িয়াছেন । তার উদ্ধারের জন্য দিলীর খ৷ সেনা লইয়া অগ্রসর হইতেছেন । সেখানে তোমার হায় যোদ্ধার সাহায্যের বিশেষ প্রয়োজন । তুমি অদ্যই যাত্রা কর /* মবারক এ সকল কথায় আহিলাদিত হইলেন না, কেন না, জানিতেন, ঔরঙ্গজেবের আদর শুভকর নহে । কিন্তু মনে যাহ। স্থির করিয়াছিলেন, তাহ ভাবিয়া দুঃখিতও হইলেন না । অতি বিনীতভাবে বাদশাহের নিকট বিদায় লইয়া দিলীর খার শিবিরে যাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন । তার পর ঔরঙ্গজেব এক জন বিশ্বাসী দূতের দ্বারা দিলীর র্থার নিকট এক লিপি প্রেরণ করিলেন । পত্রের মৰ্ম্ম এই যে, মবারক খাকে দুই হাজারি মনসবদার করিয়া তোমার নিকট পাঠাইয়াছি। সে যেন একদিনও জীবিত না থাকে। যুদ্ধে মরে, ভালই —নহিলে অন্য প্রকারে যেন মরে । দিলীর মবারককে চিনিতেন না । বাদশাহের আজ্ঞ। অবশু পালনীয় বলিয়া স্থির করিলেন । তার পর ঔরঙ্গজেব আম-দরবারে বসিয়া আপনার অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন । বলিলেন, “আমরা কাঠরিয়ার ফঁাদে পড়িয়াই সন্ধিস্থাপন করিয়াছি । সে সন্ধি রক্ষণীয় নহে । ক্ষুদ্র এক জন ভূইয়া রাজার সঙ্গে বাদশাহের আবার সন্ধি কি ? আমি সন্ধিপত্র ছিড়িয়া ফেলিয়াছি । বিশেষ সে রূপনগরের কুঙারীকে ফেরৎ পাঠায় নাই । রূপনগরীকে তাহার পিতা আমাকে দিয়াছে। অতএব রাজসিংহের তাহাতে অধিকার .নাই । তাহাকে ফিরাইয়া না দিলে, আমি রাজসিংহুকে