পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বি ... r “, Gł চিন্তায় প্রগাঢ়তর বিমনা থাকার কারণেষ্ট হউক, নগেন্দ্রের প্রবেশকালে কেহই তাহাকে দেখিল না । তখন নগেন্দ্র দ্বারদেশে দাড়াইয়৷ সেই প্রাচীনের মুখনিৰ্গত চরমকালিক দুঃখের কথাসকল শুনিতে লাগিলেন । এই দুই জন, প্রাচীন এবং বালিকা, এই বহুলোকপূর্ণ লোকালয়ে নিঃসহায় । এক দিন ইহাদিগের সম্পদ ছিল ; লোক-জন, দাস-দাসী, সহায় সৌষ্ঠব সব ছিল। কিন্তু চঞ্চলা কমলার কৃপার সঙ্গে সঙ্গে একে একে সকলই গিয়াছিল । সদ্যঃসমাগত দারিদ্র্যের পীড়নে পুত্র-কন্যার মুখমণ্ডল হিমনিষিক্তপদ্মবৎ দিন দিন স্নান দেখিয়া অগ্ৰেই গৃহিণী নদীসৈকতশয্যায় শয়ন করিলেন । আর সকল তারাগুলিও সেই চাদের সঙ্গে সঙ্গে নিবিল ৷ এক বংশধর পুত্র, মাতার চক্ষের মণি, পিতার বাৰ্দ্ধক্যের ভরসা, সে-ও পিতৃসমক্ষে চিন্তারোহণ করিল । কেহ রহিল না, কেবল প্রাচীন আর এই লোক-মনোমোহিনী বালিকা সেই বিজনবনবেষ্টিত ভগ্নগৃহে বাস করিতে লাগিল । পরম্পরে পরস্পরের একমাত্র উপায় । কুন্দনন্দিনী বিবাহের বয়স অতিক্রম করিয়াছিল, কিন্তু কুন্দ পিতার অন্ধের ষষ্টি, এই সংসার-বন্ধনের এখন একমাত্র গ্রস্থি ; বৃদ্ধ প্রাণ ধরিয়া তাহাকে পরহস্তে সমর্পণ করিতে পারিলেন না । “আর কিছু দিন যাক্, কুন্দকে বিলাইয়া দিয়া কোথায় থাকিব ? কি লইয়া থাকিব ?” বিবাহের কথা মনে হইলে, বুদ্ধ এইরূপ ভাবিতেন । এ কথা তাহার মনে হইত ন৷ ষে, বে দিন তাহার ডাক পড়িবে, সে দিন কুন্দকে কোথায় রাখিয়া যাইবেন ? আজি অকস্মাৎ যমদূত আসিয়া শয্যাপাশ্বে দাড়াইল । তিনি ত চলিলেন । কুনানন্দিনী কালি কোথায় দাড়াইবে ? এই গভীর অনিবাৰ্য্য যন্ত্রণা মুমুধুর প্রতি নিশ্বাসে ব্যক্ত, হুইতেছিল । অবিরল মুদ্রিতোলুখনেত্ৰে বারি ধারা পড়িতেছিল ; আর শিরোদেশে প্রস্তরময়ী মূৰ্ত্তির স্তায় সেই ত্রয়োদশবর্ষীয় বালিকা স্থিরদৃষ্ট্রে মৃত্যু মেঘাচ্ছন্ন পিতৃমুখপ্রতি চাহিয়াছিল । আপন ভুলিয়া কালি কোথা যাইবে, তাহা ভুলিয়া, কেবল গমনোন্মুখের মুখপ্রতি চাহিয়াছিল । ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধের বাক্যমূৰ্ত্তি অস্পষ্টতর হইতে লাগিল । নিশ্বাস কণ্ঠাগত হইল, চক্ষু নিস্তেজ হইল ; ব্যথিত প্রাণ ব্যথা হইতে নিষ্কৃতি পাইল । সেই নিভৃত কক্ষে, স্তিমিত প্রদীপে কুন্দনন্দিনী একাকিনী পিতার মৃতদেহ ক্রোড়ে লইয়া রছিলেন। নিশা ঘনাদ্ধকারাবৃতা ; বাহিরে এখনও বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি পড়িতেছিল, বৃক্ষপত্রে তাহার শব্দ হইতেছিল, বায়ু রহিয়া রন্থিয় গর্জন করিতেছিল, Yo 8 ভগ্নগৃহের কবাট সকল শদিত হইতেছিল । গৃহমধ্যে নিৰ্ব্বাণোন্মুখ চঞ্চল ক্ষীণ প্রদীপালোক ক্ষণে ক্ষণে শৰমুখে পড়িয়া আবার ক্ষণে ক্ষণে অন্ধকারবৎ হইতেছিল। সে প্রদীপে অনেকক্ষণ তৈলসেক হয় নাই । এই সময়ে দুই চারিবার উজ্জ্বলতর হইয়া প্রদীপ নিবিয়া গেল । তখন নগেন্দ্র নিঃশব্দপদ-সঞ্চারে গৃহদ্বার হইতে অপস্ব ভ হইলেন । তৃতীয় পরিচ্ছেদ ছায়া পূৰ্ব্বগামিনী নিশীথ-সময় । ভগ্নগৃহমধ্যে কুন্দনন্দিনী ও তাহার পিতার শব . কুন্দ ডাকিল, “বাবা!” কেহ উত্তর দিল না। কুন্দ একবার মনে করিল, পিতা ঘুমাইলেন, আবার মনে করিল, বুঝি মৃত্যু —কুন্দ সে কথা স্পষ্ট মুখে আনিতে পারিল না । শেষে কুন্দ আ র ডাকিতেও পারিল না, ভাবিতেও পারিল না, অন্ধকারে ব্যজনহস্তে যেখানে তাহার পিতা জীবিভাবস্থায় শয়ান ছিলেন, এক্ষণে ষেখানে তাহার শব পড়িয়াছিল, সেইখানে বায়ুসঞ্চালন করিতে লাগিল। নিদ্রাই শেষে স্থির করিল, কেন না, মরিলে কুন্দের দশ৷ কি হইবে ? দিবারাত্রি জাগরণে এবং এক্ষণকার ক্লেশে বালিকার তন্দ্ৰ আসিল । কুন্দনন্দিনী রাত্রিদিবা. জাগিয়া পিতৃসেবা করিয়াছিল, নিদ্রাকর্ষণ হইলে কুন্দনন্দিনী তালবৃন্তহস্তে সেই অনাবৃত কঠিন শীতল হৰ্ম্ম্যতলে আপন লৈনিন্দিত বাহুপরি মস্তকরক্ষা করিয়৷ নিদ্রা গেল । তখন কুন্দনন্দিনী স্বপ্ন দেখিল । দেখিল, যেন রাত্রি অতি পরিষ্কার জ্যোৎস্নাময়ী, আকাশ উজ্জল নীল ; সেই প্রভাময় নীল আকাশমণ্ডলে যেন বৃহৎ চন্দ্রমণ্ডলের বিকাশ হইয়াছে । এত বড় চন্দ্রমণ্ডল কুন্দ কখন দেখে নাই । তাহার দীপ্তিও অভিশন্থ ভাস্বর, অথচ নয়নস্নিগ্ধকর। কিন্তু সেই রমণীয় প্রকাণ্ড চন্দ্রমণ্ডলমধ্যে চন্দ্র নাই । তৎপরিবর্তে কুন্দ মণ্ডল মধ্যবৰ্ত্তিমী এক অপূৰ্ব্ব জ্যোতিৰ্ম্ময়ী দৈবীমূৰ্ত্তি দেখিল । সেই জ্যোতিৰ্ম্ময়ী মূৰ্ত্তিমনাথ চন্দ্রমণ্ডল যেন উচ্চ গগন পরিত্যাগ করিয়া ক্রমে ক্রমে ধীরে ধীরে নীচে নামিতেছিল । ক্রমে সেই চন্দ্রমণ্ডল সহস্ৰ শীতলরশ্মি ফুরিত করিয়া কুন্দনন্দিনীর মস্তকের উপর আসিল । তখন কুন্দ দেখিল যে, সেই মণ্ডলমধ্যশোভিনী, আলোকময়ী, কিরীটকুণ্ডলাদিভূষণালব্ধতা মূৰ্ত্তি স্ত্রীলোকের আকৃতিবিশিষ্ট । রমণীয় কারুশপরিপূর্ণ মুখমণ্ডল, স্নেহপরিপূর্ণ হান্ত অধরে ফুরিত