পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিষবৃক্ষ থাকে, সাধ্যানুসারে কখন সে দিকে নয়ন ফিরান না ; নিতান্ত প্রয়োজন না হইলে তাহার নাম মুখে আনেন না । এমন কি, তাহার প্রতি কর্কশ ব্যবহারও করিয়া থাকেন ; তাহাকে বিনাদোষে ভৎসনা করিতেও শুনিয়াছি । তবে কেন আমি এত হাবড়হাঠি লিখিয়া মরি ? পুরুষে এ কথা জিজ্ঞাসা করিলে বুঝান বড় ভার হইত, কিন্তু তুমি মেয়েমানুষ, এতক্ষণে বুঝিয়াছ । যদি কুন্দনন্দিনী অন্ত স্ত্রীলোকের মত র্তাহার চক্ষে সামান্ত হইত, তবে তিনি কেন তাহার প্রতি ন চাহিবার জন্য ব্যস্ত হইবেন ? তাহার নাম মুখে না আনিবার জন্য কেন এত যত্নশীল হইবেন ? কুন্দনন্দিনীর জন্য তিনি আপনার নিকট আপনি অপরাধী হইয়াছেন । এ জন্য কখন কখন তাহার প্রতি আকারণ ভৎসনা করেন । সে রাগ তাহার উপর নহে—আপনার উপর । সে ভৎসন। তাহাকে নহে, আপনাকে । আমি ইহা বুঝিতে পারি । আমি এত কাল পৰ্য্যন্ত অনন্যব্রত হুইয়। অস্তরে বাহিরে কেবল তাহাকেই দেখিলাম— র্তাহার ছায়া দেখিলে তাহার মনের কথা বলিতে পারি—তিনি আমাকে কি লুকাইবেন ? কখন কখন অন্তমনে তাহার চক্ষু এদিক ওদিকৃ চাহে, কাহার সন্ধানে, তাহা কি আমি বুঝিতে পারি না ? দেখিলে আবার ব্যস্ত হইয়া চক্ষু ফিরাষ্টয়া লয়েন কেন, তাহ কি বুঝিতে পারি না ? কাহার কণ্ঠের শব্দ শুনিবার জন্ত, আহারের সময় গ্রাস হাতে করিয়াও কাণ তুলিয়া থাকেন, তাহা কি বুঝিতে পারি না ? হাতের ভাত হাতে থাকে, কি মুখে দিতে কি মুখে দেন, তবু কাণ তুলিয়া থাকেন,-কেন ? আবার কুন্দের স্বর কাণে গেলে তখনই বড় জোরে হাপুস হাপুস করিয়া ভাত খাইতে আরম্ভ করেন কেন, তা কি বুঝিতে পারি না ? অামার প্রাণাধিক সৰ্ব্বদা প্রসপ্লবদন—এখন এত অষ্টমনাঃ কেন ? কথা বলিলে কথা কাণে না তুলিয়া, অন্তমনে উত্তর দেন “হু’। আমি যদি রাগ করিয়া বলি, “আমি শীঘ্ৰ মরি”, তিনি না শুনিয়া বলেন “হু” । এত অন্তমনা: কেন ? জিজ্ঞাসা করিলে বলেন, "মাকদমার জালায় আমি জানি, মোকদ্দমার কথা তাহার মনে স্থান পায় না। যখন মোকদ্দমার কথা বলেন, তখন হাসিয়া হাসিয়া কথা বলেন । আর এক কথা—এক দিন পাড়ার প্রাচীনার দল কুন্দের কথা কহিতেছিল, তাহার বাল্য-বৈধব্য, অনাথিনীন্তু এই সকল লইয়া তাহার জন্ত দুঃখ করিতেছিল । তোমার সহোদর সেখানে উপস্থিত ছিলেন । আমি অন্তরাল হইতে Sసి দেখিলাম, তাহার চক্ষু জলে পূরিয়া গেল—তিনি সহসা । দ্রুতবেগে সে স্থান হইতে চলিয়া গেলেন । এখন এক জন নুতন দাসী রাখিয়াছি—তাহার নাম কুমুদ । বাবু তাহাকে কুমুদ বলিয়৷ ডাকেন। কখন কখন কুমুদ বলিয়া ডাকিতে কুন্দ বলিয়া ফেলেন ; আর কত অপ্রতিভ হন । অপ্রতিভ কেন ? § এ কথা বলিতে পারিব না ষে, তিনি আমাকে অযত্ন বা অনাদর করেন । বরং পূর্বাপেক্ষা অধিক । যত্ন, অধিক আদর করেন । ইহার কারণ বুঝিতে পারি। তিনি আপনার মনে আমার নিকট অপরাধী ; কিন্তু ইহাও বুঝিতে পারি যে, আমি আর র্তাহার মনে স্থান পাই না । যত্ন এক, ভালবাসা অার, ইহার মধ্যে প্রভেদ কি-—আমরা স্ত্রীলোক সহজেই বুঝিতে পারি । 1. আর একটা হাসির কথা । ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে না কি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবা-বিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবা-বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তবে মুর্গ কে ? এখন বৈঠকখানায় ভট্টাচাৰ্য্য ব্রাহ্মণ আসিলে সেই গ্রন্থ লইয়। বড় তর্কবিতর্ক হয় । সে দিন চায়কচ কচি, ঠাকুর - মা সরস্বতীর সাক্ষাৎ বরপুত্র,—বিধবা-বিবাহেব পক্ষে তর্ক করিয়া বাবুর নিকট হইতে টোল মেরামতের জন্য দশট টাক লইয়া যায় । তাহার পরদিন সাৰ্ব্বভৌম ঠাকুর বিধবাবিবাহের প্রতিবাদ করেন । তাহার কস্তার বিবাহের জন্য আমি পাচ ভরির সোণার বালা গড়াইল্প দিয়াছি । আর কেহ বড় বিধবাবিবাহের দিকে নয় । আপনার দুঃখের কথা লইয়া তোমাকে অনেকক্ষণ জালাতন করিয়াছি । তুমি না জানি কত বিরক্ত হইবে । কিন্তু কি করি ভাই—তোমাকে মনের দুঃখ না বলিয়া কাহাকে বলিব ? আমার কথা এখনও ফুরায় নাই –কিন্তু তোমার মুখ চেয়ে আজ ক্ষাস্ত হইলাম। এ সকল কথা কাহাকেও বলিও না । আমার মাথার দিব্য, জামাইবাবুকে এ পত্র দেখাইও না । তুমি কি আমাদিগকে দেখিতে আসিবে না ? এই সময় একবার আসিও, তোমাকে পাইলে অনেক ক্লেশনিবারণ হইবে । তোমার ছেলের সংবাদ ও জামাইবাবুর সংবাদ শীঘ্ৰ লিখিৰে, ইতি । - স্বৰ্য্যমুখী ॥ "