পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিষবৃক্ষ রাখিল । ঘরে চাবী দিল, আরী না দেখে। পরে বাৰুর বাড়ীতে কাজে গেল। দুই প্রহর বেলায় আয়ী যখন স্নানে যায়, হীরা তখন আসিয়া . কুন্দকে স্নানাহার করাইল । আবার চাবী দিয়া চলিয়া গেল। রাত্রে আসিয়া চাব খুলিয়। উভয়ে শষ্য। রচনা করিল। “টিটু-কিটু—খিটু-খিটি-খাট্‌” বাহিরদুয়ারের শিকল সাবধানে নাড়িল । হীরা বিস্মিত হইল। এক জনমাত্র কখনও কখনও রাত্রে শিকল নীড়ে । সে বাবুর বাড়ীর দ্বারবান, রাতভিত ডাকিতে আসিয়া শিকল নাড়ে। কিন্তু তাহার হাতে শিকল অমন মধুর বলে না, তাহার হাত শিকল নাড়িলে বলে, “কটু কটু কটা, তোর মাথামুণ্ড উঠা ! কড়, কড়, কড়াং ! খিল খোল নয় ভাঙ্গি ঠ্যাং " তা ত শিকল বলিল না । এ শিকল বলিতেছে, “কিট কিটু কিটি ! দেখি কেমন আমার হীরেটি ! খিষ্ট্ৰ খাট্ ছন্‌ ! উঠলে আমার হীরামন । ঠিটু ঠিটু ঠিঠি ঠিনিকৃ— আয় রে আমার হারামাণিক ” হীরা উঠিয়। দেখিতে গেল ; বাহির-ছুয়ার পুলিয়া দেখিল, স্ত্রীলোক । প্রথমে চিনিতে পারিল না, পরেই চিনিল—“কে ও গঙ্গাজল ! এ কি ভাগ্য !" হীরার গঙ্গাজল মালতী গোয়ালিনী । মালতী গোয়ালিনীর বাড়ী দেবীপুর— দেবেন্দ্র বাবুর বাড়ীর কাছে—বড় রসিক। স্ত্রীলোক । বয়স বৎসর ত্রিশ বত্রিশ, সাড়া পর, হাতে রুলি, মুখে পানের রাগ । মালতী গোয়ালিনী প্রায় গৌরাঙ্গী-একটু রৌদ্র-পোড়–মুখে রাঙ্গ রাঙ্গা দাগ, নাক খাদা-কপালে উল্কি। কসে তামাকুপোড়া টেপা আছে। মালতী গোয়ালিনী দেবেন্দ্র বাবুর দাসী নহে—আশ্রিতাও নহে –অথচ তাহার বড় আনুগত—অনেক ফরমায়েস-যাহ অন্তর অসাধ্য, তাহা মালতী সিদ্ধ করে, মালতীকে দেখিয়া চতুর হীরা বলিল, “ভাই গঙ্গাজল ! অস্তিমকালে যেন তোমায় পাই, কিন্তু এখন কেন ?” গঙ্গাজল চুপি চুপি বলিল, “তোকে দেবেন্দ্র বাবু ডেকেছে।” হার কাদা মাখে, হাসিয়া বলিল, “তুষ্ট কিছু পাবি না কি ? মালতী দুই আঙ্গুলের দ্বারা ইরাকে মারিল ; বলিল, “মরণ আর কি ! তোর মনের মত কথা তুই জালিস এখন চ ।” হীরা ইছাই চায়। কুনকে বলিল, “আমায়ু বাবুর বাড়ী যেতে হলো—ডাকিতে এসেছে । কে জাৰে কেম ?” ৱলিয়া প্রদীপ নিবাইল এবং অন্ধকারে পারি নাই ; (فرنسي কৌশলে বেশভূষা করিয়া মালতীর সঙ্গে যাত্র করিল। দুই জনে অন্ধকারে গল মিলাইয়া— "মনের মত্তন রতন পেলে যতন করি তায় । সাগর ছেচে ভুলব নাগর পতন ক'রে কায় ” ইতি গীত গায়িতে গায়িতে চলিল । দেবেন্দ্রের বৈঠকখানায় হীরা একা গেল । " দেবেন্দ্র দেবীর আরাধনা করিতেছিলেন, কিন্তু আজি সরু কাটিতেছিলেন । জ্ঞান টল্টনে । হীরার সঙ্গে, আজ অন্য প্রকার সম্ভাষণ করিলেন, স্তবস্তুতি কিছুই নাই । বলিলেন, “হীরে, সে দিন আমি অধিক মদ খাইস্না তোমার কথার মৰ্ম্ম কিছুষ্ট গ্রন্থণ করিতে কেন আসিয়াছিলে, সেই কথা জিজ্ঞাসা করিবার জন্য ডাকিয়া পাঠাইয়াছি।” হী । কেবল আপনাকে দর্শন করিতে আসিয়া- , ছিলাম । দেবেন্দ্ৰ হাসিলেন । বলিলেন, “তুমি বড় বুঞ্জি মতী । ভাগ্যক্রমে নগেন্দ্র বাবু তোমার মত দাসী; পেয়েছেন । বুঝিলাম, তুমি হরিদাসী বৈষ্ণবীর তৰে । এসেছিলে । আমার মনের কথা জানিতে এসেছিলে । কেন আমি বৈষ্ণবী সাজি, কেন দত্তবাড়ী যাই, এই কথা জানিতে আসিয়াছিলে । তাহা এক প্রকার জানিয়াও গিয়াছ । আমিও তোমার কাছে সে কথা লুকাইব না । তুমি প্রভুর কাজ করিয়া প্রভুর কাছে পুরস্কার পাইয়াছ, সন্দেহ নাই। এখন আমার । একটি কাজ কর, আমিও পুরস্কার করব ।” মহাপীপে নিমগ্ন যাহাদিগের চরিত্র, তাহাদিগের সকল কথা স্পষ্ট করিয়া লেখা বড় কষ্টকর। দেবেন্দ্র ইরাকে বহুল অর্থের লোভ প্রদর্শন করিয়া কুন্দকে । বিক্রয় করিতে বলিলেন । শুনিম্ন ক্রোধে হীরার পদ্মপলাশ-চক্ষু রক্তময় হইল—কর্ণরন্ধে অগ্নিবৃষ্টি হইল । হীরা গাত্ৰোখান করিয়া কহিল, “মহাশয়! আমি দাসী বলিয়। এরূপ কথা বলিলেন । ইহার উত্তর আমি দিতে পারিব না। আমার মুনিবকে বলিব । তিনি ইহার উপযুক্ত উত্তর দিবেন " এই বলিয়া হীরা বেগে প্রস্থান করিল। দেবেন্দ্র ক্ষণেককাল অপ্রতিভ এবং ভগ্নোৎসাহ হইয়া নীরব হইয়াছিলেন । পরে প্রাণ ভরিয়া দুই গ্লাস ব্রাপ্তি পান করিলেন । তখন প্রকৃতিস্থ হইয়৷ মৃদু মৃদ্ধ গায়িলেন,— “এসেছিল বক্ন। গরু পর-গোয়ালে জাব না খেতে—*