পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

* 8% না । কিন্তু সে উদ্যান প্রাচীরবেষ্টিত। খিড়কীর দ্বার মুক্ত না হইলে, তাহার মধ্যে প্রবেশের পথ নাই । বাহির হইতেও তাঁহা দেখা যায় না। খিড়কীর দ্বার মুক্ত কি রুদ্ধ, ইহা দেখিবার জন্ত কুন্দ সেই দিকে গেল । দেখিল, দ্বার মুক্ত। কুন্দ সাহসে ভর করিয়া তন্মধ্যে প্রবেশ করিল, এবং উদ্যানপ্রাস্তে ধীরে ধীরে আসিয়া এক বকুলবৃক্ষের অন্তরালে দাড়াইল । উদ্যানটি ঘন বৃক্ষলতাগুল্মরাজিপরিবৃত ৷ বৃক্ষশ্রেণীমধ্যে প্রস্তররচিত মুন্দর পথ, স্থানে স্থানে শ্বেভ, রক্ত, নীল, পীতবর্ণ বহু কুমুমরাশিতে বৃক্ষাদি মণ্ডিত হইয়া রহিয়াছে। তদুপরি প্রভাতমধুলুব্ধ মক্ষিকা সকল দলে দলে ভ্ৰমিতেছে, বসিতেছে, উড়িতেছে,— গুন্‌ গুম্‌ শব্দ করিতেছে । এবং মনুষ্যের চরিত্রের অনুকরণ করিয়া একটা একটা বিশেষ মধুযুক্ত ফুলের উপর পালে পালে ঝুঁকিতেছে। বিচিত্রবর্ণ অতি ক্ষুদ্র পক্ষিগণ প্রস্ফুটিত পুষ্পগুচ্ছোপরি বৃক্ষফলবৎ আরোহণ করিয়া পুস্পরস পান করিতেছে, কাহারও কণ্ঠ হইতে সপ্তস্বর-সংমিলিত ধ্বনি নির্গত হইতেছে। প্রভাতবায়ুর মন্দহিল্লোলে পুষ্পভারাবনত ক্ষুদ্র শাখা দুলিতেছে —পুস্পইন শাখাসকল ছলিতেছে না, কেন না, তাহারা নম্র নহে । কোকিল মহাশয় বকুলের ঝোপের মধ্যে কালবৰ্ণ লুকাইয়া গলাবাণ্ডিতে সকলকে জিতিতেছেন । উদ্যানমধ্যস্থলে একটি শ্বেতপ্রস্তরনিৰ্ম্মিত লতামণ্ডপ । তাহ অবলম্বন করিয়া নানাবিধ লতা পুষ্পধারণ করিয়া রহিয়াছে এবং তাহার ধারে মৃত্তিকাধারে রোপিত সপুষ্প গুল্মসকল শ্রেণীবদ্ধ হইয়া রহিয়াছে । কুন্দনন্দিনী বকুলান্তরাল হইতে উদ্যানমধ্যে দৃষ্টিপাত করিয়া নগেন্দ্রের দীর্ঘস্থত দেবমূৰ্ত্তি দেখিতে পাইল না। লতামণ্ডপমধ্যে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিল যে, তাহার প্রস্তরনিৰ্ম্মিত স্নিগ্ধ হৰ্ম্ম্যোপরি কেহ শয়ন করিয়া রহিয়াছে, কুন্দনন্দিনীর বোধ হইল, সেই নগেন্দ্র । ভাল করিয়া দেখিবার জন্য সে ধীরে ধীরে বৃক্ষের অন্তরালে অন্তরালে থাকিয়া অগ্রবৰ্ত্তিনী হইতে লাগিল। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সময়ে লতামণ্ডপস্থ ব্যক্তি গাত্ৰোখান করিয়া বাহির হইল। হতভাগিনী কুন্দ দেখিল যে, সে নগেন্দ্র নহে, স্বৰ্য্যমুখী । কুন্দ তখন ভীত হইয়া এক প্রস্ফুটিত কামিনীর অন্তরালে দাড়াইল। ভয়ে অগ্রসর হইতে পারিল না, পশ্চাদপস্থতও হইতে পারিল না । দেখিতে লাগিল, স্বৰ্য্যমুখী উদ্যানমধ্যে পুষ্পচয়ন করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। যেখানে কুন্দ লুকাইয়া আছে, স্বৰ্যমুখী বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী 蜀 ক্রমে সেই দিকে আসিতে লাগিলেন । কুন্দ দেখিল যে, ধরা পড়িলাম । শেষে স্বৰ্য্যমুখী কুন্দকে দেখিতে পাইলেন । দুর হইতে চিনিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও কে গা ?” কুন্দ ভয়ে নীরব হুইয়া রছিল—পা সরিল না। স্বৰ্য্যমুখী তখন নিকটে আসিলেন-দেখিলেন— চিনিলেন যে, কুন্দ। বিস্থিত হইয়া কহিলেন, “কে, কুন্দ না কি ?” কুন্দ তখনও উত্তর করিতে পারিল না । স্বৰ্য্যমুখী কুন্দের হাত ধরিলেন, বললেন, “কুন্দ ! এসো --দিদি এসে । আর আমি তোমায় কিছু বলিব না ।” এই বলিয়। স্বর্যমুখী হস্ত ধরিয়া কুন্দনন্দিনীকে অস্তঃপুরমধ্যে লক্টয়া গেলেন । চতুৰ্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ অবতরণ সেই দিন রাত্রে দেবেন্দ্র দত্ত একাকী ছদ্মবেশে, সুরারঞ্জিত হইয়া কুন্দনন্দিনীর অনুসন্ধানে হীরার বাড়ীতে দর্শন দিলেন, এ ঘর ও ঘর খুজিয়া দেখিলেন, কুন্দ নাই। হীরা মুখে কাপড় দিয়া হাসিতে লাগিল । দেবেন্দ্র রুষ্ট হইয়া জিজ্ঞাস করিলেন, "হাসিস্ কেন ?” হীরা বলিল, “তোমার দুঃখ দেখে । পিঞ্জরার পার্থী পলাইয়াছে— আমার খানাতল্লাসী করিলে পাইবে ন! ” তখন দেবেন্দ্রের প্রশ্নে হীরা যাহাঁ যাহ। জানিত, আদ্যোপাস্ত কহিল । শেষে কহিল, "প্রভাতে তাহাকে না দেখিয়া অনেক খুজিলাম, খুজিতে খুজিতে বাবুদের বাড়ীতে দেখিলাম—এবার বড় অাদর ” দেবেন্দ্র হতাশ্বাস হুইয়। ফিরিয়৷ আসিতেছেন, কিন্তু, মনের সন্দেহ মিটিল না । ইচ্ছা—আর একটুকু ষসিয়া ভাবগতিক বুঝিয়া যান। আকাশে একটু কাণা মেঘ ছিল দেখিয়া বলিলেন, “বুঝি বৃষ্টি এলে৷ ” অনস্তর ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন । হীরার ইচ্ছ, দেবেন্দ্র একটু বসেন–কিন্তু সে স্ত্রীলোক—একাকিনী থাকে—তাহাতে রাত্রি—বসিতে বলিতে পারিল না । তাহা হইলে অধঃপাতের সোপানে আর এক পদ নামিতে হয় । তাহাও তাহার কপালে ছিল। দেবেন্দ্র বলিলেন, “তোমার ঘরে ছাতি আছে ?”