পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গেন্দ্রের চক্ষে একটি তারাও স্বন্দর বোধ হইল না। জ্যোৎস্ন৷ অত্যন্ত কর্কশ বোধ হইতে লাগিল। দৃষ্টপদার্থমাত্রেই চক্ষুশূল বলিয়া বোধ হইল। পৃথিবী অত্যন্ত নৃশংস। সুখের দিনে যে শোভা ধারণ করিষা মনোহরণ করিয়াছিল, আজি সেই শোভা বিকাশ করে কেন ? ষে দীর্ঘতৃণে চন্দ্রকিরণ প্রতিবিম্বিত হইলে হৃদয় স্নিগ্ধ হইত, আজি সে দীর্ঘতৃণ তেমনি সমুজ্জল কেন ? আজিও আকাশ তেমনি নীল, মেঘ তেমনি শ্বেত, নক্ষত্র তেমনি উজ্জল, বায়ু তেমনি ক্রীড়াশীল । পশুগণ তেমনি বিচরণ করিতেছে ; মনুষ্য তেমনি হাস্ত্যপরিহাসে রত, পৃথিবী তেমনি $ অনন্তগামিনী ; সংসারস্রোতঃ তেমনি অপ্রতিহত । জগতের দয়াশূন্যতা আর সহ হয় না। কেন পৃথিবী বিদীর্ণ হইয়া নগেন্দ্রকে শিবিক সমেত গ্রাস করিল Fil ? নগেন্দ্র ভাবিয়া দেখিলেন, সব তারই দোষ । র্তাহার তেত্রিশ বৎসর মাত্র বয়ঃক্রম হইয়াছে। ইহারই মধ্যে র্তাহার সব ফুরাইল। অথচ জগদীশ্বর র্তাহাকে যাহা দিয়াছিলেন, তাহার কিছুই ফুরাইবার নহে । যাহাতে যাহাতে মনুষ্য সুখী, সে সব তাহাকে ঈশ্বর যে পরিমাণে দিয়াছিলেন, সে পরিমাণে প্রায় কাহাকেও দেন না। ধন, ঐশ্বৰ্য্য, সম্পদ, মান, এ সকল ভূমিষ্ঠ হইয়াই অসাধারণ পরিমাণে পাইয়া ছিলেন। বৃদ্ধি নহিলে এ সকল সুখ হয় না--তাহাতে বিধাত কার্পণ্য করেন নাই । শিক্ষায় পিতা-মাতা ক্রটি করেন নাই—তাহার তুল্য সুশিক্ষিত কে ? রূপ, বল, স্বাস্থ্য, প্রণয়শীলতা, তাহাও ত প্রকৃতি র্তাহাকে অমিত হস্তে দিয়াছেন ; ইহার অপেক্ষাও যে ধন স্বল্প ভ—যে একমাত্র সামগ্রী এ সংসারে অমূল্য— অশেষ প্রণয়শালিনী সাধ্বী ভাৰ্য্যা—ইহাও তাহার প্রসন্ন কপালে খটিয়াছিল । সুখের সামগ্রী পৃথিবীতে এত অার কাহার ছিল ? আজি এত অসুখী পৃথিবীতে কে ? আজ যদি তাহার সর্বস্ব দিলে--ধন, সম্পদ, মনি, রূপ, ८यौवन, বিদ্যা, বুদ্ধি, সব দিলে, তিনি আপন শিবিকার এক জন বাহকের সঙ্গে অবস্থা পরিবর্তন করিতে পারিতেন, তাহা হইলে স্বৰ্গমুখ মনে করিতেন। বাহক কি ?–ভাবিলেন, এই দেশের রাজকারাগারে এমন কে নরত্ন পাপী আছে যে, আমার অপেক্ষ মুখী নয় ? আমা হতে পবিত্র নয় ? তারা ত অপরকে হত করিয়াছে, আমি স্বৰ্য্যমুখীকে বধ করিয়াছি। আমি ইন্দ্রিয় দমন করিলে স্বৰ্য্যমুখী বিদেশে আসিয়া কুটারদাহে মরিৰে কেন ? আমি স্বৰ্য্যমুখীর

  • বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী

বধকারী-কে এমন পিতৃক্ষ, মাতুয়, পুত্রয় আছে যে, আমার অপেক্ষ গুরুতর পাপী ? সূৰ্য্যমুখী কি কেবল আমার স্ত্রী ? স্বৰ্য্যমুখী আমার—সব। সম্বন্ধে স্ত্রী, সোঁহার্দে ভ্রাতা, যত্নে ভগিনী, আপ্যায়িত করিতে কুটুম্বিনী, স্নেহে মাতা, ভক্তিতে কস্তা, প্রমোদে বন্ধু, পরামর্শে শিক্ষক,পরিচর্য্যায় দাসী। আমার সুর্য্যমুখী— কাহার এমন ছিল ? সংসারে সহায়, গৃহে লক্ষ্মী, হৃদয়ে ধৰ্ম্ম, কণ্ঠে অলঙ্কার! আমার নয়নের তারা, হৃদয়ের শোণিত, দেহের জীবন, জীবনের সর্বস্ব ! আমার প্রমোদে হৰ্ষ, বিষাদে শান্তি, চিন্তায় বুদ্ধি, কার্য্যে উৎসাহ ! আর এমম সংসারে কি আছে ? অামার দর্শনে আলোক, শ্রবণে সঙ্গীত, নিঃশ্বাসে বায়ু, স্পর্শে জগৎ । আমার বর্তমানের মুখ, অতীতের স্মৃতি, ভবিষ্যতের আশা, পরলোকের পুণ্য। আমি শূকর, রত্ব চিনিব কেন ?” হঠাৎ তাহার স্মরণ হইল যে, তিনি সুখে শিবিকারোহণে যাইতেছেন ; স্বৰ্য্যমুখী পথ ছাটিয়া ছাটিয়া পীড়িত হইয়াছিলেন । আমনি নগেন্দ্র শিবিকা হইতে অবতরণ করিয়া পদব্রজে চলিলেন । বাহকের শূন্ত শিবিক পশ্চাৎ পশ্চাৎ আনিতে লাগিল। প্রাতে যে . বাজারে আসিলেন, সেইখানে শিবিক ত্যাগ করিয়া বাহকদিগকে বিদায় দিলেন । অবশিষ্ট পথ পদব্রজে অতিবাহিত করিলেন । তখন মনে করিলেন, “এ জীবন এই সূৰ্য্যমুখীর বধের প্রায়শ্চিত্তে উৎসর্গ করিব । কি প্রায়শ্চিত্ত ? স্বৰ্য্যমুখী গৃহত্যাগ করিয়া যে সকল সুখে বঞ্চিত হইয়াছিলেন—আমি সে সকল মুখভোগ ত্যাগ করিবঃ ঐশ্বৰ্য্য, সম্পদ, দাস-দাসী, বন্ধু-বান্ধবের আর কোন সংস্রব রাখিব না । স্বৰ্য্যমুখী গৃহত্যাগ করিয়া অবধি যে সকল ক্লেশ ভোগ করিয়াছিলেন, আমি সেই সকল । ক্লেশ ভোগ করিব । যে দিন গোবিন্দপুর হইতে যাত্রা করিব, সেই দিন হইতে আমার গমন পদব্রজে, ভোজন কদন্ন, শয়ন বৃক্ষতলে বা পর্ণকুটীরে। আর কি প্রায়শ্চিত্ত ? যেখানে যেখানে অনাথ স্ত্রীলোক দেখিব, সেইখানে প্রাণ দিয়া তাহার উপকার করিব। যে অর্থ নিজব্যয়ার্থে রাখিলাম, সেই অর্থে আপনার প্রাণধারণমাত্র করিয়া, অবশিষ্ট সহায়হীনা স্ত্রীলোকদিগের সেবার্থে ব্যয় করিব । যে সম্পত্তি স্বত্ব ত্যাগ করিয়া সতীশকে দিব, তাহারও আৰ্দ্ধাংশ আমার ষাবজ্জীবন সতীশ সহায়হীন স্ত্রীলোকদিগের সাহুষ্যার্থ ব্যয় করিবে, ইহাও দানপত্রে লিখিয়া দিব । প্রায়শ্চিত্ত ! পাপেরই প্রায়ুশ্চিত্ত হয় । দুঃখের ত প্রায়শ্চিত্ত নাই। দুঃখের প্রায়শ্চিত্ত কেবল মৃত্যু।.