পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৬২ আর ব্যস্ত না হইয়া এবং কাহাকেও কিছু না বলিয়া তিনি পুরুষোত্তম যাত্রা করেন । সেখান হইতে প্রত্যাবৰ্ত্তন করিয়া তোমার সন্ধানার্থ পুনশ্চ গোবিন্দপুর গিয়াছিলেন । সেখানে তোমার কোন সংবাদ পাইলেন না—শুনিলেন, আমার কাছে তোমার সংবাদ পাইবেন । আমার কাছে আসিলেন। পরশ্ব আমার কাছে আসিয়াছিলেন, আমি তাহাকে তোমার পত্র দেখাইলাম। তিনি তখন মধুপুরে তোমার সাক্ষাৎ পাইবার ভরসায় কালি গিয়াছেন । কালি রাত্রে রাণীগঞ্জে তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হুইবার সম্ভাবনা ছিল । নগেন্দ্র । আমি কালি রাণীগঞ্জে ছিলাম ন}, স্বৰ্য্যমুখীর কথ। তিনি তোমাকে কিছু বলিয়াছিলেন ? ঐশ। সে সকল কালি বলিব । নগেন্দ্র । তুমি মনে করিতেছ, শুনিয়া আমার ক্লেশ বৃদ্ধি হইবে। এ ক্লেশের আর বৃদ্ধি নাই। তুমি বল । তখন শ্ৰীশচন্দ্র ব্রহ্মচারীর নিকট শ্রত র্তাহার সহিত স্বৰ্য্যমুখীর সঙ্গে পথে সাক্ষাতের কথা, পীড়ার কথা এবং চিকিৎসা ও অপেক্ষাকৃত আরোগ্যলাভের "কথা বলিলেন । অনেক বাদ দিয়া বলিলেন,— স্বৰ্য্যমুখী কত দুঃখ পাইয়াছিলেন, সে সকল বলিলেন না । শুনিয়া, নগেন্দ্র গৃহ হইতে নির্গত হইলেন। শ্ৰীশচন্দ্র সঙ্গে যাইতেছিলেন, কিন্তু নগেন্দ্র বিরক্ত হইয়া নিষেধ করিলেন। পথে পথে নগেন্দ্র রাত্রি দুই প্রহর পর্য্যস্ত পাগলের মত বেড়াইলেন । ইচ্ছা, জনস্রোতোমধ্যে আত্মবিস্মৃতি লাভ করেন । কিন্তু জনস্রোত তখন মন্দীভূত হইয়াছিল—আর আত্মবিস্মৃতি কে লাভ করিতে পারে ? তখন পুনৰ্ব্বার শ্ৰীশচন্দ্রের গৃহে ফিরিয়া আসিলেন। শ্ৰীশচন্দ্র আবার নিকটে বসিলেন। নগেন্দ্র বলিলেন, “আরও কথা আছে । তিনি কোথায় গিয়াছিলেন, কি করিয়াছিলেন, তাহ ব্ৰহ্মচারী অবশু র্তাস্থার নিকট শুনিয়া থাকিবেন । ব্রহ্মচারী তোমাকে ৰলিয়াছেন কি ?” , , ঐশ। আজি আর সে কথায় কাজ কি ? আজি थांख আছ, বিশ্রাম কর । নগেন্দ্র ভ্ৰকুটা করিয়া মহাপরুষ কণ্ঠে কহিলেন, “বল ?” শ্ৰীশচন্দ্র নগেন্দ্রের মুখপ্রতি চাহিয়া দেখিলেন, মগেঞ্জ পাগলের মত হইয়াছেন ; বিদ্যুদগর্ত মেঘের মত র্তাহার মুখ কালীময় হইয়াছে। ভীত হইয়া ঐশচন্দ্র বলিলেন, "বগিতেছি ” নগেন্দ্রের মুখ প্রসন্ন হইল, শ্ৰীশচন্দ্র সংক্ষেপে বলিলেন, “গোবিন্দপুর বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী । হইতে স্বৰ্য্যমুখী স্থলপথে অল্প অল্প করিয়া প্রথমে পদব্রজে এই দিকে আসিয়াছিলেন ।” নগেন্দ্র। প্রত্যহু কত পথ চলিত ? শ্ৰীশ । এক ক্রোশ, দেড় ক্রোশ । নগেন্দ্র। তিনি ত একটি পয়সাও লইয়া বাড়ী হইতে যান নাই—দিনপাত হুইত কিলে ? - ঐশ। কোন দিন উপবাস—কোন দিন ভিক্ষা —তুমি পাগল । এই বলিয়া শ্ৰীশচন্দ্র নগেন্দ্রকে তাড়ন করিলেন। কেন না, নগেন্দ্র আপনার হস্তদ্বারা আপনার কণ্ঠরোধ করিতেছেন দেখিতে পাইলেন । বলিলেন, “মরিলে কি স্বৰ্য্যমুখীকে পাইবেন ?” এই বলিয়া নগেন্দ্রের হস্ত লইয়া আপনার হস্তমধ্যে রাখিলেন। নগেন্দ্র বলিলেন, “বল ।” ঐশ। তুমি স্থির হইয়া না শুনিলে আমি আর বলিব না। কিন্তু শ্ৰীশচন্দ্রের কথা আর নগেন্দ্রের কর্ণে প্রবেশ হইল না। তাহার চেতন বিলুপ্ত হইয়াছিল। নগেন্দ্র মুদ্রিতনয়নে স্বর্গারূঢ় স্বৰ্য্যমুখীর রূপ ধ্যান করিতেছিলেন। দেখিতেছিলেন—তিনি রত্নসিংহাসনে রাজরাণী হইয়া বসিয়াছেন ; চারিদিক্ হইতে শীতল সুগন্ধময় পবন তাহার অলকদাম দুলাইতেছে ; চারি দিকে পুষ্পনিৰ্ম্মিত বিহঙ্গমগণ উড়িয়া বীণারবে গান করিতেছে । দেখিলেন, তাহার পদতলে শত শত কোকনদ ফুটিয়া রহিয়াছে ; তাহার সিংহাসনচন্দ্রা" তপে শতচন্দ্র জ্বলিতেছে ; চারি পাশ্বে শত শত নক্ষত্র জলিতেছে । দেখিলেন, নগেন্দ্র স্বয়ং এক অন্ধকার পূর্ণ স্থানে পড়িয়া আছেন ; তাহার সর্বাঙ্গে বেদন ; অম্বরে তাহকে বেত্ৰাঘাত করিতেছে ; স্বৰ্য্যমুখী অঙ্গুলি সঙ্কেতে র্তাহাদিগকে নিষেধ করিতেছেন । অনেক যত্নে শ্ৰীশচন্দ্র নগেন্দ্রের চেতনাবিধান করিলেন । চেতনাপ্রাপ্ত হইয়া নগেন্দ্র উচ্চৈঃস্বরে ডাকিলেন, “স্বৰ্য্যমুখি ! প্রাণাধিকে ! কোথায় তুমি ?” টীৎকার শুনিয়া শ্ৰীশচন্দ্র স্তম্ভিত এবং ভীত হইয়া নীরবে বসিলেন। ক্রমে নগেন্দ্র স্বভাবে পুনঃস্থাপিত হুইয়। বলিলেন, “বল ।” ঐশচন্দ্র ভীত হইয়া বলিলেন, “আর কি বলিব ?” নগেন্দ্র । বল, নহিলে আমি এখনই প্রাণত্যাগ করিব । ভীত শ্ৰীশচন্দ্র পুনৰ্ব্বার বলিতে লাগিলেন, “স্বৰ্য্যমুখী অধিক দিন এইরূপ কষ্ট পান নাই। এক জন ধনাঢ্য ব্রাহ্মণ সপরিবারে কাশী যাইতেছিলেন । তিনি কলিকাতা পৰ্য্যন্ত নৌকাপখে আসিতেছিলেন ;