পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিষবৃক্ষ বিনা জিজ্ঞাসাবাদে সতীশকে লইয়া জীশচন্দ্রের নৌকায় গিয়া উঠিলেন । কমলমণি আগে গোবিন্দপুরে আসিলেন, দেখিয়া কুন্দনন্দিনীর বোধ হইল, আবার আকাশে একটি তারা উঠিল। ষে অবধি স্থৰ্য্যমুখী গৃহত্যাগ করিয়া গিয়াছিলেন, সেই অবধি কুন্দনন্দিনীর উপর কমলমণির দুর্জয় ক্রোধ ; মুখ দেখিতেন না । কিন্তু এবার আসিয়া কুন্দনন্দিনীর শুষ্কমূৰ্ত্তি দেখিয়া কমল মণির রাগ দূর হইল-দুঃখ হইল। তিনি কুননন্দিনীকে প্রফুল্ল করিবার জন্য যত্ন করিতে লাগিলেন ; নগেন্দ্র অসিতেছেন, সংবাদ দিয়া কুনের মুখে হাসি দেখিলেন । সূৰ্য্যমুখীর মৃত্যুসংবাদ দিতে কাজে কাজেই হইল। শুনিয়া কুন্দ কঁদিল । এ কথা শুনিয়া, এ গ্রন্থের অনেক সুন্দরী পাঠকারিণী মনে মনে হাসিবেল ; আর বলিবেন, “মাছ মরেছে, বেরাল কাদে ” কিন্তু কুন্দ বড় নিৰ্ব্বোধ । সতীন মরিলে যে হাসিতে হয়, সেটা তার মোটা বুদ্ধিতে আসে নাই। বোকা মেয়ে সতীনের জন্যও একটু কাদিল । আর তুমি ঠাকুরাণি ! তুমি যে হেসে হেসে বলুতেছ, “মাছ মরেছে বেরাল কঁাদে”—তোমার সতীন মরিলে তুমি যদি একটু কাদ, তা হইলে আমি বড় তোমার উপর খুলী হব । কমলমণি কুন্দকে শান্ত করিলেন । কমলমণি নিজে শাস্ত হইয়াছিলেন । প্রথম প্রথম কমল অনেক কাদিয়াছিলেন—তার পরে ভাবিলেন, “কাদিয়া কি করিব ? আমি কাদিলে শ্ৰীশচন্দ্র অসুখী হন—আমি কাদিলে সতীশ কাদে—কাদিলে ত স্বর্যমুখী ফিরিবে না, তবে কেন এদের কাদাই ? আমি কখনও স্বৰ্য্যমুখীকে ভুলিব না, কিন্তু আমি হাসিলে যদি সতীশ হাসে, তবে কেন হাসব না?” এই ভাবিয়া কমলমণি রোদন ত্যাগ করিয়া আবার সেই কমলমণি হইলেন । কমলমণি শ্ৰীশচন্দ্রকে বলিলেন, “এ বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী ত বৈকুণ্ঠ ত্যাগ করিয়া গিয়াছেন। তাই ব’লে দাদাবাৰু বৈকুণ্ঠে এসে কি বটপত্রে শোবেন ?” শ্ৰীশচন্দ্র বলিলেন, “এসো, আমরা সব পরিষ্কার করি।” অমনি শ্ৰীশচন্দ্র রাজ, মজুর, ফরাস, মালী, যেখানে যাহার প্রয়োজন, সেখানে তাহাকে নিযুক্ত করিলেন । এ দিকে কমলমণির দৌরাত্ম্যে ছুঁচ, বাদুড়, চামচিকে মহলে বড় কিচি মিচি পড়িয়া গেল ; পায়রাগুলা ৰকম্‌ৰকম্‌” করিয়া এ কাৰ্ণিশ ও কাৰ্ণিশ করিয়া বেড়াইতে লাগিল ; চড়ুইগুলা পলাইতে ७१ ব্যাকুল—ষেখানে সার্সী বন্ধ, সেখানে দ্বার খোলা' মনে করিয়৷ ঠোটে কাচ লাগিয়া ঘুরিয়া পড়িতে । লাগিল ; পরিচারিকার ঝাটা হাতে জনে জনে, দিকে দিকে দিগ্বিজয়ে ছুটিল । অচিরাৎ অট্টালিকা আবার প্রসন্ন হইয়া হাসিতে লাগিল । - পরিশেষে নগেন্দ্র আসিয়া পৌঁছিলেন। তখন সন্ধ্যাকাল । যেমন নদী প্রথম জলোচ্ছ্বাসকালে অত্যন্ত বেগবতী, কিন্তু জোয়ার পূরিলে গভীর জল শান্তভাৰ ধারণ করে, তেমনি নগেন্দ্রের সম্পূর্ণ শোকপ্রবাহ এক্ষণে গম্ভীর শাস্তিরূপে পরিণত হইয়াছিল। যে দুঃখ, তাহা কিছুই কমে নাই ; কিন্তু অধৈৰ্য্যের হ্রাস হইয়া আসিয়াছিল। তিনি স্থিরভাবে পৌরবর্গের সঙ্গে কথাবাৰ্ত্ত কহিলেন, সকলকে ডাকিয়া জিজ্ঞাস:ি করিলেন, কাহারও সাক্ষাতে তিনি স্বৰ্য্যমুখীর প্রসঙ্গ করিলেন না—কিন্তু তাহার ধীরভাব দেখিয়া সকলেই র্তাহার দুঃখে দুঃখিত হইল। প্রাচীন ভূত্যেরার্তাহাকে প্রণাম করিতে গিয়া আপনা আপনি রোদন: করিল ; নগেন্দ্র কেবল একজনকে মনঃপীড়া · দিলেন । চিরদুঃখিনী কুন্দনন্দিনীর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন না । চতুশ্চত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ স্তিমিত প্রদীপে নগেন্দ্রের আদেশমত পরিচারিকার স্বৰ্য্যমুখীর শয্যাগৃহে তাহার শয্যা প্রস্তুত করিয়াছিল। শুনিয়া কমলমণি ঘাড় নাড়িলেন। নিশীথকালে, পৌরজন সকলে স্বযুপ্ত হইলে, নগেন্দ্র . স্বৰ্য্যমুখীর শয্যাগৃহে শয়ন করিতে গেলেন। শয়ন করিতে নী—রোদন করিতে। স্বৰ্য্যমুখীর শয্যাগৃহ অতি প্রশস্ত এবং মনোহর ; উহা নগেন্দ্রের সকল । মুখের মন্দির, এই জন্য তাহা যত্ন করিয়া প্রস্তুত্ত করিয়াছিলেন। ঘরটি প্রশস্ত এবং উচ্চ, হৰ্ম্ম্যতল শ্বেতকৃষ্ণ মৰ্ম্মর-প্রস্তরে রচিত। কক্ষপ্রাচীরে নীল, পিঙ্গল, লোহিত লতাপল্লব-ফলপুষ্পাদি চিত্রিতঃ তদুপরি বসিয়া নানাবিধ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বি৷ ফলভক্ষণ করিতেছে, লেখা আছে । এক বহুমূল্য দারুনিৰ্ম্মিত হস্তিদন্তখচিত কারুকার্য পৰ্য্যন্ধ, আর এক পাশে বিচিত্র বস্ত্রমণ্ডিত নানাদি কাষ্ঠাসন এবং বৃহদৰ্পণ প্রভৃতি গৃহসজ্জার বস্তু স্ক্রিয় ছিল। কয়খানি চিত্র কক্ষপ্রাচীর হইতে বিলক্টি