পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যুগলাঙ্গুরীয় প্রথম পরিচ্ছেদ ছুই জনে উদ্যানমধ্যে লতামগুপতলে দাড়াইয়া ছিলেন । তখন প্রাচীন নগর তাম্রলিপ্তের * চরণ ধৌত করিয়া অনন্ত নীল সমুদ্র মৃদু মৃদু নিনাদ করিতেছিল । তাম্রলিপ্ত নগরের প্রান্তভাগে সমুদ্রতীরে এক বিচিত্র অট্টালিকা ছিল । তাহার নিকট একটি স্বনিৰ্ম্মিত বৃক্ষবাটিকার অধিকারী ধনদাস নামক একজন শ্রেষ্ঠ । শ্রেষ্ঠীর কন্যা হিরন্ময়ী লতামণ্ডপে দাড়াইয়া এক যুৱা পুরুষের সঙ্গে কথা কহিতেছিলেন । হিরন্ময়ী বিবাহের বয়স অতিক্রম করিয়াছিলেন । তিনি ঈপ্সিত স্বামীর কামনায় একাদশ বৎসরে আরম্ভ করিয়া ক্রমাগত পঞ্চ বৎসর এই সমুদ্রতীরবাসিনী সাগরেশ্বরী নায়ী দেবীর পূজা করিয়াছিলেন, কিন্তু মনোরথ সফল হয় নাই । প্রাপ্তযৌবন কুমারী কেন যে এই যুবার সঙ্গে এক কথা কহেন, তাহ সকলেই জানিত । হিরন্ময়ী যখন চারি বৎসরের বালিকা, তখন এই যুবার বয়ঃক্রম আট বৎসর। ইহার পিভা শচীসুত শ্রেষ্ঠ ধনদাসের প্রতিবাসী, এ জন্ত উভয়ে একত্র বাল্যক্রীড়া করিতেন ; হয় শচীস্বতের গৃহে, নয় ধনদাসের গৃহে সৰ্ব্বদা একত্রে সহবাস করিতেন। এক্ষণে যুবতীর বয়স ষোড়শ, যুবার বয়স বিংশতি বৎসর, তথাপি উভয়ের সেই বালসখিত্ব সম্বন্ধই ছিল, একটুমাত্র বিঘ্ন ঘটিয়াছিল। যথাবিহিত কালে উভয়ের পিতা, এই যুবক-যুবতীর পরস্পরের সঙ্গে বিবাহসম্বন্ধ করিয়াছিলেন। বিবাহের দিন স্থির পর্যস্ত হইয়াছিল। অকস্মাৎ হিরন্ময়ীর পিত্তা বলিলেন, “আমি বিবাহ দিব না।” সেই অবধি হিরন্ময়ী আর পুরন্দরের সহিত সাক্ষাৎ করিতেন না। অদ্য পুরন্দর অনেক বিনয় করিয়া, বিশেষ কথা আছে বলিয় তাহাকে ডাকিয়া আনিয়াছিলেন। লতামণ্ডপতলে আসিয়া হিরন্ময়ী কহিলেন, “আমাকে কেন ডাকিয়া আনিলে ? অামি এক্ষণে আর বালিকা নহি । SSASAS SSAS SSAS SSAS SSAS • আধুনিক তমলুক। পুরাবৃত্তে পাওয়া যায় যে, পূৰ্ব্বকালে এই নগর সমুদ্রতীরবর্তী ছিল। এখন আর তোমার সঙ্গে এমত স্থলে একা সাক্ষাৎ করা ভাল দেখায় না, আর ডাকিলে আমি আসিব না ।” - ষোল বৎসরের বালিকা বলিতেছে, “আমি আর বালিকা নহি, ইহা বড় মিষ্ট কথা । কিন্তু সে রস অমুভব করিবার লোক সেখানে কেহই ছিল না । পুরন্দরের বয়স বা মনের ভাব সেরূপ নহে । পুরন্দর মণ্ডপবিলম্বিত লতা হইতে একটি পুপ তাঙ্গিয়া লইয়া তাহ ছিন্ন করিতে করিতে বলিলেন, “আমি আর ডাকিব না। আমি দূরদেশে চলিলাম । তাই তোমাকে বলিয়া যাইতে আসিয়াছি।” হি। দূরদেশে ? কোথায় ? পু ! সিংহলে । হি। সিংহলে ? সে কি ? কেন সিংহলে যাইবে ? পু। "কেন যাইব ? আমরা শ্রেষ্ঠ, বাণিজ্যার্থ যাইব ।”—বলিতে বলিতে পুরন্দরের চক্ষু ছল-ছল করিয়া আসিল । হিরণ্ডায়ী বিমনা হইলেন ; কোন কথা কছিলেন না, অনিমিষলোচনে সন্মুখবর্তী সাগর-তরঙ্গে স্বৰ্য্যকিরণের ক্রীড়া দেখিতে লাগিলেন। প্রাতঃকাল, মৃত্নপবন বহিতেছে, মৃদুলপবনোখিত অতুঙ্গ তরঙ্গে বালারুণরশ্মি আরোহণ করিয়া কঁাপিতেছে- সাগরজলে তাহার অনন্ত উজ্জল রেখা প্রসারিত হইয়াছে— · শুIমাঙ্গীর অঙ্গে রজতালঙ্কারবৎ ফেননিচয় শোভিতেছে, তীরে জলচর পক্ষিকুল শ্বেতরেখা সাজাইয়া বেড়াইতেছে । হিরণায়ী সব দেখিলেন ;–নীল জল দেখিলেন, তরঙ্গশিরে ফেনমাল। দেখিলেন, স্বৰ্য্যরশ্মির ক্রীড়া দেখিলেন, দূরবর্তী অর্ণবপোত দেখিলেন, নীলাশ্বরে কৃষ্ণবিন্দুবৎ একটি পক্ষী উড়িতেছে, তাহাও দেখি লেন। শেষে ভূতলশায়ী একটি শুষ্ক কুসুমের প্রতি দৃষ্টি করিতে করিতে কছিলেন, “তুমি কেন যাবে, অন্যান্য বার তোমার পিতা যাইরা: থাকেন ।” . . পুরন্দর বলিলেন, “আমার পিতা বৃদ্ধ হইতেছেন । , আমার এখন অর্থোপার্জনের সময় হইয়াছে । আমি : পিতার অনুমতি পাইয়াছি।” .