পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী হেম। মাধবাচাৰ্য্য ভিন্ন এ মন্ত্রণ কাহার ? আমি মৃণালিনীর ধাত্রীর মুখে শুনিলাম যে, মৃণালিনী আমার আঙ্গটি দেখিয়া কোথায় গিয়াছে, আর তাহার উদ্দেশ নাই। আমার আঙ্গটি আপনি পাথেয় জন্য চাহিয়া লইয়াছিলেন । আঙ্গটির পরিবর্তে অন্য রত্ন দিতে চাহিয়াছিলাম ; কিন্তু আপনি লন নাই । তখনই, আমি সন্দিহান হুইয়াছিলাম ; কিন্তু আপনাকে আদেয় আমার কিছুই নাই, এই জন্তই বিনা বিবাদে আঙ্গটি দিয়াছিলাম। কিন্তু আমার সে অসতর্কতার আপনিই সমুচিত প্রতিফল দিয়াছেন । মাধবাচার্য্য কহিলেন, “যদি তাহাই হয়, আমার উপর রাগ করিও না। তুমি দেবকাৰ্য্য না সাধিলে কে সাধিবে ? তুমি যবনকে না তাড়াইলে কে তাড়াইবে ? যবননিপাত তোমার একমাত্র ধ্যানস্বরূপ হওয়া উচিত। এখন মৃণালিনী তোমার মন অধিকার করিবে কেন ? একবার তুমি মৃণালিনীর আশায় মথুরায় বসিয়াছিলে বলিয়া তোমার বাপের রাজ্য হারাইয়াছ, যবনাগমনকালে হেমচন্দ্র যদি মথুরায় না থাকিয়া মগধে থাকিত, তবে মগধজয় কেন হইবে ? আবার কি সেই মৃণালিনৗপাশে বদ্ধ হইয়া নিশ্চেষ্ট হইয়া থাকিবে ? মাধবাচার্য্যের জীবন থাকিতে তাহা হইবে না । স্বতরাং যেখানে থাকিলে ভূমি মৃণালিনীকে পাইবে না, আমি তাহাকে সেই'খানে রাখিয়াছি।” হেম। আপনার দেবকাৰ্য্য আপনি উদ্ধার করুন ; আমি এই পৰ্য্যন্ত । মা ! তোমার দুৰ্ব্বদ্ধি ঘটিয়াছে। এই কি তোমার দেবভক্তি ? ভাল, তাহাই না হউক, দেবতারা আত্মকৰ্ম্মসাধন জন্য তোমার দ্যায় মনুষ্যের সাহায্যের অপেক্ষা করেন না । কিন্তু তুমি কাপুরুষ যদি না হও, তবে তুমি কি প্রকারে শক্ৰশাসন হইতে অবসর পাইতে চাও ? এই কি তোমার বীরগৰ্ব্ব ? এই কি তোমার শিক্ষা ? রাজবংশে জন্মিয়৷ কি প্রকারে আপনার রাজ্যোদ্ধারে বিমুখ হইতে চাহিতেছ ? হেম । রাজ্য—শিক্ষা–গৰ্ব্ব অতল জলে ডুবিয়া शाउँक । মা । নরাধম! তোমার জননী কেন তোমায় দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করিয়া যন্ত্রণাভোগ করিয়াছিল ? কেনই বা দ্বাদশ বর্ষ দেবারাধনা ত্যাগ করিয়া এ পাষণ্ডকে সকল বিদ্যা শিখাইলাম ? মাধবাচাৰ্য্য অনেকক্ষণ নীরবে করলগ্নকপোল হইয়৷ রছিলেন। ক্রমে হেমচন্দ্রের অনিন্দ্যগেীর মুখকান্তি মধ্যাহ্নমরীচি-বিশোষিত স্থলপদ্মবৎ আরক্তবর্ণ হইয়া আসিতেছিল কিন্তু গর্ভাগ্নিগিরিশিখর তুল্য তিনি স্থিরভাবে দাড়াইয়৷ রহিলেন । পরিশেষে মাধবাচার্য্য কহিলেন, “হেমচন্দ্র ! ধৈৰ্য্যাবলম্বন কর । মৃণালিনী কোথায়, তাহ বলিব—মৃণালিনীর সহিত তোমার বিবাহ দেওয়াইব । কিন্তু এক্ষণে আমার পরামর্শের অনুবৰ্ত্তী হও, আগে আপনার কাজ সাধন কর ” হেমচন্দ্র কহিলেন, “মৃণালিনী কোথায় না বলিলে আমি যবনবধের জন্য অস্ত্র স্পর্শ করিব না ।” মাধবাচার্য্য কহিলেন, “আর যদি মৃণালিনী মরিয়া থাকে ?” হেমচন্দ্রের চক্ষু হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইল। তিনি কহিলেন, “ভবে সে আপনারই কাজ ।” মাধবাচার্য্য কহিলেন,—“আমি স্বীকার করিতেছি, আমিই দেবকার্য্যের কণ্টককে বিনষ্ট করিয়াছি।” হেমচন্দ্রের মুখকান্তি বর্ষণোন্মুখ মেঘবৎ হইল । ত্রস্তহস্তে ধনুকে শরসংযোগ করিয়া কহিলেন, "যে মৃণালিনীর বধকৰ্ত্তা, সে আমার বধ্য । এই শুরে গুরুহত্যা, ব্ৰহ্মহত্যা উভয় দুক্ৰিয়া সাধন করিব।” মাধবাচার্য্য হাস্ত করিলেন, কহিলেন, “গুরুহত্য, ব্রাহ্মণহত্যায় তোমার যত আমোদ, স্ত্রীহত্যায় আমার তত নহে। এক্ষণে তোমাকে পাতকের ভাগী হইতে হইবে না । মুণালিনী জীবিত আছে। পার, তাহার সন্ধান করিয়া সাক্ষাৎ কর । এক্ষণে আমার আশ্রম হইতে স্থানান্তরে যাও, আশ্রম কলুষিত করিও না ; অপাত্রে আমি কোন ভার দিই ন! ” এই বলিয়৷ মাধবাচার্য্য পূৰ্ব্ববৎ জপে নিযুক্ত হইলেন । হেমচন্দ্র আশ্রম হইতে নির্গত হইলেন । ঘাটে আসিয়া ক্ষুদ্র তরণী আরোহণ করিলেন । যে দ্বিতীয় ব্যক্তি নৌকায় ছিল, তাহাকে বলিলেন, “দিগ্বিজয় ! নৌকা ছাড়িয়া দাও।” দিগ্বিজয় বলিল, “কোথা যাইব ?” হেমচন্দ্র বলিলেন, "যেখানে ইচ্ছ—যমালয় ।” দিগ্বিজয় প্রভুর স্বভাব বুঝিত। অস্ফুটস্বরে কহিল, “সেটা অল্প পথ”, এই বলিয়া সে তরণী ছাড়িয়া দিয়া স্রোতের প্রতিকুলে বাহিতে লাগিল। হেমচন্দ্র অনেকক্ষণ নীরব থাকিয়া শেষে কহিলেন, “দুর হউক! ফিরিয়া চল ।” দিগ্বিজয় নৌকা ফিরাইয়া পুনরপি প্রয়াগের ঘাটে উপনীত হইল। হেমচন্দ্ৰ লম্ফে তীরে অবতরণ করিয়া পুনৰ্ব্বার মাধবাচার্য্যের আশ্রমে গেলেন । র্তাহাকে দেখিয়া মাধবাচাৰ্য্য কহিলেন, “পুনৰ্ব্বার কেন আসিয়াছ ?”