মৃণালিনী ব্রাহ্মণ আনন্দিত হইয়া রাজপুত্রকে আশীৰ্ব্বাদ করিলেন এবং কহিলেন, “মনোরমা, ব্রাহ্মণীকে বল, রাজপুত্র তাহার নাতি হইলেন –আশীৰ্ব্বাদ করুন।” এই বলিয়া ব্রাহ্মণ স্বয়ং ব্রাহ্মণি ! ব্রাহ্মণি ” বলিয়া ডাকিতে লাগিলেন । ব্রাহ্মণী তখন স্থানান্তরে গৃহকাৰ্য্যে ব্যাপৃত ছিলেন—ডাক শুনিতে পাইলেন না । ব্রাহ্মণ অসন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “ব্রাহ্মণীর ঐ বড় দোষ । কাণে কম শোনেন ।” তৃতীয় পরিচ্ছেদ নৌকাযানে হেমচন্দ্র ত উপবনগৃহে সংস্থাপিত হইলেন। আর মৃণালিনী ? নিৰ্ব্বাসিত, পরপীড়িত, সহায়হীন মৃণালিনী কোথায় ? সান্ধ্যগগনে রক্তিম মেঘমালা কাঞ্চনবর্ণ ত্যাগ করিয়া ক্রমে ক্রমে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করিল । রজনীদত্ত তিমিরাবরণে গঙ্গার বিশাল হৃদয় অস্পষ্টীকৃত হুইল । সভামণ্ডপে পরিচারক হস্তজালিত দীপমালার দ্যায়, অথবা প্রভাতে উদ্যানকুসুমসমূহের স্তায় আকাশে নক্ষত্রগণ ফুটিতে লাগিল । প্রায়ান্ধকার নদীঙ্গদয়ে নৈশ সমীরণ কিঞ্চিৎ খরতরবেগে বহিতে লাগিল । তাহাতে রমণীহৃদয়ে নায়কসংস্পৰ্শজনিত প্রকম্পের ন্যায় নদীফেনপুঞ্জে শ্বেতপুষ্পমালা গ্রথিত হইতে লাগিল । বহু লোকের কোলাহলের ন্যায় বাঁচিরব উত্থিত হইল । নাবিকের নৌকাসকল তীরলগ্ন করিয়। রাত্রির জন্ত বিশ্রামের ব্যবস্থা করিতে লাগিল। তন্মধ্যে একখানি ছোট ডিঙ্গী অন্ত নৌকা হইতে পৃথক্ এক খালের মুখে লাগিল । নাবিকের আহারাদির ব্যবস্থা করিতে লাগিল । ক্ষুদ্র তরণীতে দুইটিমাত্র আরোহী । দুইটিই স্ত্রীলোক । পাঠককে বলিতে হইবে না, ইহার মৃণালিনী অার গিরিজায়া । গিরিজায়া মৃণালিনীকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “আজিকার দিন কাটিল ।” মৃণালিনী কোন উত্তর করিল না । গিরিজায় পুনরপি কহিল, “কালিকার দিনও কাটিবে—পরদিনও কাটিবে—কেন কাটিবে না ?” মৃণালিনী তথাপি কোন উত্তর করিলেন না। কেবলমাত্র দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন । * গিরিজায়া কহিল, “ঠাকুরাণি । এ কি এ ? দিবানিশি চিন্তু করিয়া কি হইবে ? যদি আমাদিগের
- ፄ
»s নদীয় আসা কাজ ভাল ন হইয়া থাকে, চল, এখনও ফিরিয়া যাই ।” মৃণালিনী এবার উত্তর করিলেন । “কোথায় যাইবে ?” গি । চল, হৃষীকেশের বাড়ী যাই । মু । বরং এই গঙ্গাজলে ডুবিয়া মরিব । গি । চল, তবে মথুরায় যাই । মৃ । আমি ত বলিয়াছি, তথায় আমার স্থান নাই। কুলটার ন্যায় রাত্রিকালে যে বাপের ধর ছাড়িয়া আসিয়াছি, কি বলিয়া সে বাপের ঘরে আর মুখ দেখাইব ? গি । কিন্তু তুমি ত আপন ইচ্ছায় আইস নাই, মন্দ ভাবিয়াও আইস নাই । যাইতে ক্ষতি কি ? - মু। সে কথা কে বিশ্বাস করিবে ? সে বীপের ঘরে অাদরের প্রতিমা ছিলাম, সে বাপের ঘরে ঘৃণিত হইয়াই বা কি প্রকারে থাকিব ? গিরিজায়। অন্ধকারে দেখিতে পাইল না যে, মৃণালিনীর চক্ষু হইতে বারিবিন্দুর পর,বারিবিন্দু পড়িতে লাগিল । গিরিজায়া কহিল, “তবে কোথায় যাইবে ?” মু। যেখানে যাইতেছি । গি । সে ত মুখের যাত্রা। তবে অন্তমন কে ন ? যাহাকে দেখিতে ভালবাসি, তাহাকে দেখিতে যাইতেছি, ইহার অপেক্ষা আর মুখ কি আছে ? মৃ । নদীয়ায় অামার সহিত হেমচন্দ্রের সাক্ষাৎ হইবে না । গি । কেন ? তিনি কি সেখানে নাই ? মৃ। সেইখানেই আছেন । কিন্তু তুমি ত জান যে, আমার সহিত এক বৎসর অসাক্ষাৎ তাহার ত্রত। আমি কি সে ব্রত ভঙ্গ করাইব ? গিরিজায়া নীরব হইয়া রহিল। মৃণালিনী আবার কহিলেন, “আর কি বলিয়াই বা তাহার নিকট দাড়াইব ? আমি কি বলিব যে, হৃষীকেশের উপর রাগ করিয়া আসিয়াছি, ন বলিব যে, হৃষীকেশ আমাকে কুলটা বলিয়া বিদায় করিয়া দিয়াছে ?” গিরিজায়। ক্ষণেক নীরব থাকিয়া কহিল, “তবে কি নদীয়ায় তোমার সঙ্গে হেমচন্দ্রের সাক্ষাৎ হইবে না ?” মৃ । না । গি তবে যাইভেছ কেন ? মৃ । তিনি আমাকে দেখিতে পাইবেন না । কিন্তু আমি তাহাকে দেখিব । তাহাকে দেখিতেই | বলিলেন,