পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/২১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মৃণালিনী 鲇 নিরস্ত হইলেন, তথাপি অমুদিন মৃণালিনী-চিন্তায় হৃদয় নিযুক্ত থাকিত । একদা প্রদোষকালে তিনি শয়নকক্ষে, পৰ্য্যস্কোপরি শয়ন করিয়া মৃণালিনীর চিন্তা করিতেছিলেন । চিন্তাতেও হৃদয় সুখলাভ করিতেছিল । মুক্ত বাতায়নপথে হেমচন্দ্র প্রকৃতির শোভা নিরীক্ষণ করিতেছিলেন । নবীন শরফুদয় । রজনী চন্দ্রিক|শালিনী, আকাশ নিৰ্ম্মল, বিস্তুত নক্ষত্রখচিত, কচিৎ স্তরপরম্পরাবিন্যস্ত শ্বেতাম্বুদমালায় বিভূষিত। বাতায়নপথে অদূরবর্কিনী ভাগীরথাও দেখা যাইতেছিল ; ভাগীরথী বিশালোরসী, বহুদুরবিসপিণী ও চন্দ্রকরপ্রতিঘাতে উজ্জ্বলতরঙ্গিণী, দুরপ্রান্তে ধূমময়ী, নববারিসমাগম-প্রস্থলাদিনী । নববারি-সমাগমজনিত কল্লোল হেমচন্দ্ৰ শুনিতে পাইতেছিলেন । বাতায়ন-পথে বায়ু প্রবেশ করিতেছিল । বায়ু গঙ্গাতরঙ্গে নিক্ষিপ্ত জলকণা সংস্পর্শে শীতল, নিশাসমাগমে প্রফুল্ল বন্তকুসুম-সংস্পর্শে সুগন্ধি, চন্দ্রকরপ্রতিঘার্তা শুামো" জ্জল বৃক্ষপত্র বিধৃত করিয়া, নদীতীরবিরাজিত কাশকুসুম আন্দোলিত করিয়া, বায়ু বাতায়ন-পথে প্রবেশ করিতেছিল ; হেমচন্দ্র বিশেষ প্রাতিলাভ করিলেন । অকস্মাৎ বাতায়নপথ অন্ধকার হুইল–চন্দ্রালোকের গতিরোধ হইল । হেমচন্দ্র বাতায়ূনসন্নিধি একটি মনুষ্যমুণ্ড দেখিতে পাইলেন । বাতামুন ভূমি হইতে কিছু উচ্চ—এ জষ্ঠ কাহারও হস্তপদাদি কিছু দেখিতে পাইলেন নী—কেবল একখানি মুখ দেখিলেন । মুখখানি অতি বিশালশ্বখ্রসংযুক্ত, তাহার মস্তকে উষ্ণাষ । সেই উজ্জল চন্দ্রালোকে বাতায়নের নিকটে, সম্মুখে শ্বশসংসও উষ্ণাষধারী মনুষ্যমুণ্ড দেখিয়া, হেমচন্দ্ৰ শস্য হইতে লৰ্ম্ম দিয়৷ নিজ শাণিত আসি গ্ৰহণ করিলেন । আসি গ্রহণ করিয়া হেমচন্দ্র চাহিয়া দেখিলেন যে, বাতায়নে আর মনুষ্যমুণ্ড নাই । হেমচন্দ্র অসিহস্তে দ্বারোদঘাটন করিয়া গৃহ হইতে নিক্রোস্ত হইলেন । বাতায়নতলে আসিলেন । তথার কেহই নাই । গৃহের চতুষ্পার্শে, গঙ্গাতীরে, বনমধ্যে হেমচন্দ্র ইতস্ততঃ অন্বেষণ করিলেন । কোথাও কাহাকে দেখিলেন না । হেমচন্দ্র গৃহে প্রত্যাবৰ্ত্তন করিলেন। তখন রাজপুত্র পিতৃদত্ত যোদ্ধৃবেশে আপাদমস্তক আত্মশরীর মণ্ডিত করিলেন । অকালজলদোদয়বিমৰ্ষিত গগনমণ্ডলবৎ র্তাহার সুন্দর মুখকান্তি অন্ধকারময় হইল । তিনি একাকী সেই গম্ভীর নিশাতে ૨છે শস্ত্রময় হইয়া যাত্রা করিলেন। বাতায়নপথে মনুষ্যমুণ্ড দেখিয়া, তিনি জানিতে পারিয়াছিলেন যে, বঙ্গে তুরক আসিয়াছে । পঞ্চম পরিচ্ছেদ বাপীকুলে অকালজলদোদয়স্বরূপ ভীমমূৰ্ত্তি রাজপুত্র হেমচন্দ্র তুরকের অন্বেধণে নিষ্ক্রান্ত হইলেন । ব্যাঘ্র যেমন আহার্ষ্য দেখিবামাত্র বেগে ধাবিত হয়, হেমচন্দ্র তুরক দেখিবামাত্র সেইরূপ ধাবিত হইলেন । কিন্তু কোথায় তুরকের সাক্ষাং পাইবেন, তাহার স্থিরত। ছিল না । হেমচন্দ্র একটিমাত্র তুরক দেখিয়াছিলেন । কিন্তু তিনি এই সিদ্ধাস্ত করিলেন যে, হয় তুরকসেনা নগরসন্নিধানে উপস্থিত হইয়া লুক্কায়িত আছে, নতুবা এই ব্যক্তি তুরকসেনার পূর্বচর । যদি তুরকসেনাই আসিয়া থাকে, তবে তৎসঙ্গে একাকী সংগ্রাম সন্তৰে না। কিন্তু যাহাই হউক, প্রকৃত অবস্থা কি, ভাহার অনুসন্ধান না করিয়া হেমচন্দ্ৰ কদাচ স্থির থাকিতে পারেন না । যে মহৎ কাৰ্য্যের জন্য মৃণালিনীকে ত্যাগ করিয়াছেন, অদ্য রাত্রিতে নিদ্রাভিভূত হইয়া সে কৰ্ম্মে উপেক্ষা করিতে পারেন না । বিশেষ ষবনবধে হেমচন্দ্রের আন্তরিক আনন্দ । উষ্ণীষধারী মুণ্ড দেখিয়া অবধি তাহার জিঘাংসা ভয়ানক প্রবল হইয়াছে, সুতরাং তাহার স্থির হইবার সম্ভাবনা কি ? অতএব দ্রুতপদবিক্ষেপে হেমচন্দ্র রাজপথাভিমুখে চলিলেন । উপবনগৃহ হইতে রাজপথ কিছু দূর । যে পথ বাহিত করিয়া উপবনগৃহ হইতে রাজপথে যাইতে হয়, সে বিরললোকপ্রবাহ গ্ৰাম্যপথমাত্র । হেমচন্দ্র সেই পথে চলিলেন । সেই পথপাশ্বে অতি বিস্তারিত, সুরম্য সোপানাবলিশোভিত এক দীর্ঘিকা ছিল । দীর্ঘিকাপার্শ্বে অনেক বকুল, শাল, অশোক, চম্পক, কদম্ব, অশ্বথ, বট, আম্র, তিন্তিড়ী প্রভৃতি বৃক্ষ ছিল । বৃক্ষগুলি ষে সুশৃঙ্খলন্ধপে শ্রেণীবিন্যস্ত ছিল, এমত নহে, বহুতর বৃক্ষ পরস্পর শাখায় শাখায় সংবদ্ধ হইয়া বাপীতীরে ঘনান্ধকার করিয়া রহিত । দিবসেও তথায় অন্ধকার । কিংবদন্তী ছিল যে, সেই সরোবরে ভূতযোনি বিহার করিত। এই সংস্কার প্রতিবাসীদিগের মনে এরূপ দৃঢ় হইয়া উঠিয়াছিল ষে, সচরাচর