পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/২৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী দোকান ছিল । সে কায়স্থ—আমরাও কায়স্থ—সেই জন্য একটু আত্মীয়তা হইয়াছিল। কালী বস্থর একটি চারি বৎসরের শিশুপুত্র ছিল । তাহার নাম বামাচরণ। বামাচরণ সৰ্ব্বদা আমাদের বাড়ীতে আসিত । এক দিন একটা বর বাজনা বাজাইয়া মন্দগামী ঝড়ের মত আমাদিগের বাড়ীর সন্মুখ দিয়া যায়। দেখিয়া বামাচরণ জিজ্ঞাসা করিল—“ও কে ও ?” আমি বলিলাম, ও বর ” বামাচরণ তখন কান্না আরম্ভ করিল—“আমি বল হব ।” তাহাকে কিছুতেই থামাইতে না পারিয়া বলিলাম, কাদিস না, তুই আমার বর ” এই বলিয়া একটা সন্দেশ তাহার হাতে দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেমন, তুই আমার বর হবি ?” শিশু সন্দেশ হাতে পাইয়া রোদন সংবরণ করিয়া বলিল, “হ’ব ।” সন্দেশ সমাপ্ত হইলে, বালক ক্ষণেক কাল পরে বলিল, “ই গী, বলে কি কলে গা ?” বোধ হয় তাহার ধ্রুব বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, বরে বুঝি কেবল সন্দেশই খায় । যদি তা হয়, তবে সে অার একটা আরম্ভ করিতে প্রস্তুত। ভাব বুঝিয়া আমি বলিলাম, “বরে ফুলগুলি গুছিয়ে দেয় ।” বামাচরণ স্বামীর কৰ্ত্তব্যকৰ্ত্তব্য বুঝিয়া লইয়া, ফুলগুলি আমার হাতে গুছাইয়া তুলিয়া দিতে লাগিল । সেই অবধি আমি তাহাকে বর বলি, সে আমাকে ফুল গুছাইয়া দেয় । আমার এই দুই বিবাহ—এখন এ কালের জটিলাকুটিলাদিগকে আমার জিজ্ঞাস্ত—আমি সতী বলাইতে পারি কি ? দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ বড় বাড়ীতে ফুল যোগান বড় দায় । সে কালের মালিনী মাসী রাজবাড়ীতে ফুল যোগাইয়া মশানে গিয়াছিল। ফুলের মধু খেলে বিদ্যাম্বন্দর, কিল খেলে হীরা মালিনী—কেন না, সে বড় বাড়ীতে ফুল যোগাইত। সুন্দরের সেই রামরাজ্য হইল—কিন্তু মালিনীর কিল আর ফিরিল না । বাবা ত ‘বেলফুল” হাকিয়া রসিকমহলে ফুল বেচিতেন, মা দুই একটা অরসিক-মহলে ফুল নিত্য যোগাইতেন ; তাহার মধ্যে রামসদয় মিত্রের বাড়ীই প্রধান । রামসদয় মিত্রের সাড়ে চারিটা ঘোড়৷ ছিল—( নাতিদের একটা পণি, আর আদত চারিটা ) সাড়ে চারিটা ঘোড়া আর দেড়খানা গৃহিণী। একজন আদিত—একজন চিরকুয়া এবং প্রাচীনা, তাহার নাম ভুবনেশ্বরী—কিন্তু তার গলার সাই সাই শব্দ গুনিয়া রামমণি ভিন্ন অন্ত নাম আমার মনে আসিত না । আর যিনি পুরা একখানি গৃহিণী, তাহার নাম লৰঙ্গলত। লবঙ্গলতা লোকে বলিত, কিন্তু তার পিতা নাম রাখিয়াছিলেন,—ললিতলবঙ্গলতা এবং রামসদয় বাবু আদর করিয়া বলিতেন, “ললিতলবঙ্গলতা পরিশীলনকোমলমলয়সমীরে ” রামসদয় বাবু প্রাচীন, বয়ঃক্রম ৬৩ বৎসর । ললিতলবঙ্গলতী নবীনা, বয়স ১৯ বৎসর। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী, আদরের আদরিণী, গৌরবের গোঁরৰিণী, মানের মানিনী, নয়নের মণি, ষোল আনা গৃহিণী । তিনি রামসদয়ের সিন্দুকের চাবি, বিছানার চাদর, পানের চূণ, গেলাসের জল। তিনি রামসদয়ের জরে কুইনাইন, কাসিতে ইপিকা, বাতে ফ্রানেল এবং আরোগ্যে সুরুয়া । নয়ন নাই—ললিতলবঙ্গলতাকে কখন দেখিতে পাইলাম না—কিন্তু শুনিয়াছি, তিনি রূপসী । রূপ যাউক, গুণ শুনিয়াছি, লবঙ্গ বাস্তবিক গুণবতী । গৃহকার্য্যে নিপুণ, দানে মুক্তহস্তী, হৃদয়ে সরলা, কেবল বাক্যে বিষময়ী। লবঙ্গলতার অশেষ গুণের মধ্যে একটি এই যে, তিনি বাস্তবিক পিতামহের তুল্য সেই স্বামীকে ভালবাসিতেন-কোন নবীন নবীন স্বামীকে সেরূপ ভালবাসেন কি ন সন্দেহ । ভালবাসিতেন বলিয়া, তাহাকে নবীন সাজাইতেন-সে সজ্জার রস কাহাকে বলি ? আপন হস্তে নিত্য শুভ্রকেশে কলপ মাখাইয়া কেশগুলি রঞ্জিত করিতেন । যদি রামসদয় লজ্জার অনুরোধে কোন দিন মলমলের ধুতি পরিত, স্বহস্তে তাহা ত্যাগ করাইয়। কোকিলপেড়ে, ফিতে পেড়ে, কবাপেড়ে পরাইয়া দিতেন—মলমলের ধুতিখানি তৎক্ষণাৎ বিধবা দরিদ্রদিগকে বিতরণ করিতেন । রামসদয় প্রাচীন বয়সে আতরের শিশি দেখিলে ভয়ে পলাইত— লবঙ্গলতী, তাহার নিদ্রাবস্থায় সৰ্ব্বাঙ্গে আতর মাখাইয়া দিতেন । রামসদয়ের চসমাগুলি লবঙ্গ প্রায় চুরি করিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিত, সোণাটুকু লইয়া, যাহার কন্যার বিবাহের সম্ভাবনা, তাহাকে দিত । রামসদয়ের নাক ডাকিলে, লবঙ্গ ছয়গাছা মল বাহির করিয়া পরিয়া ঘরময় ঝম্ িঝম্ করিয়া রামসদয়ের নিদ্রা ভাঙ্গিয়া দিত । লবঙ্গলত আমাদের ফুল কিনিত-চার আনার ফুল লইয়া দুই টাকা মূল্য দিত। তাছার কারণ, আমি কাণ । মালা পাইলে লবঙ্গ গালি দিত, বলিত, “এমন কদর্ঘ্য মালা আমাকে দিস কেন ?” কিন্তু মূল্য দিবার সময় ডবল পয়সার সঙ্গে ভুল