পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/২৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

** وكfers Br=[ == s আমল্লনাথের কথা প্রথম পরিচ্ছেদ আমার এই অসার জীবনের ক্ষুদ্র কাহিনী লিখিবার বিশেষ প্রয়োজন আছে । এ সংসার সাগরে কোন চরে লাগিয়া আমার এ নৌকা ভাঙ্গিয়াছে, তাহা এই বিশ্বচিত্রে আঁকিয়। রাখিব, দেখিয়া নবীন নাবিকের সতর্ক হইতে পারিবে । আমার নিবাস অথবা পিত্ৰালয় শান্তিপুর - আমার বর্তমান বাসস্থানের কিছুমাত্র স্থিরতা নাই । আমি সৎ-কায়স্থ কুলোদ্ভূত, কিন্তু আমার পিতৃকুলে একটি গুরুতর কলঙ্ক ঘটিয়াছিল । আমার খুল্লতাতপত্নী কুলত্যাগিনী হইয়াছিলেন । আমার পিতার ভূসম্পত্তি যাহা ছিল—তদ্বারা অন্য উপায় অবলম্বন না করিয়াও সংসারযাত্রা নিৰ্ব্বাহ করা যায় । লোকে তাহাঁকে ধনী বলিয়া গণনা করিত । তিনি আমার শিক্ষার্থ অনেক ধনব্যয় করিয়াছিলেন । আমিও কিঞ্চিৎ লেখাপড়া শিখিয়াছিলাম—কিন্তু সে কথায় কাজ নাই ৷ সৰ্পের মণি থাকে, আমারও বিদ্যা ছিল । আমার বিবাহযোগ্য বয়স উপস্থিত হইলে, আমার অনেক সম্বন্ধ আসিল—কিন্তু কোন সম্বন্ধই পিতার মনোমত হইল না ; তাহার ইচ্ছা, কন্য পরম মুন্দরী হইবে, কন্যার পিতা পরম ধনী হইবে এবং কোলীন্যের নিয়ম সকল বজায় থাকিবে । কিন্তু এরূপ কোন সম্বন্ধ উপস্থিত হইল না। আসল কথা, আমাদিগের কুলকলঙ্ক শুনিয়া কোন বড় লোক আমাকে কন্যাদান করিতে ইচ্ছুক হয়েন নাই । এইরূপ সম্বন্ধ করিতে করিতে আমার পিতার পরলোকপ্রাপ্তি হইল । পরিশেষে পিতার স্বৰ্গারোহণের পর আমার এক পিসী এক সম্বন্ধ উপস্থিত করিলেন । গঙ্গাপার, কালিকাপুর নামে এক গ্রাম ছিল । এই ইতিহাসে ভবানীনগর নামে অন্য গ্রামের নাম উত্থাপিত হইবে, এই কালিকাপুর সেই ভবানীনগরের নিকটস্থ গ্রাম । আমার পিসীর শ্বশুরালয় সেই কালিকাপুরে। সেই খানে লবঙ্গ নামে, কোন ভদ্রলোকের কস্তার সঙ্গে পিলী আমার সম্বন্ধ উপস্থিত করিলেন । সম্বন্ধের পূৰ্ব্বে আমি লবঙ্গকে সৰ্ব্বদাই দেখিতে পাইতাম । আমার পিসীর বাড়ীতে আমি মধ্যে মধ্যে যাইতাম । লবঙ্গকে পিসীর বাড়ীতেও দেখিতাম--তাহার পিত্রালয়েও দেখিতাম । মধ্যে মধ্যে লবঙ্গকে শিশুবোধ হইতে কয়ে করাত, খয়ে খরা শিখাইতাম । যখন তাহার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ হইল, তখন হইতে সে আমার কাছে আর আসিত না ; কিন্তু সেই সময়ে আমিও তাহারে দেখিবার জন্ত অধিকতর উৎসুক হইয়া উঠিলাম। তখন লবঙ্গের বিবাহের বয়ঃক্রম উত্তীর্ণ হইয়াছিল—লবঙ্গকলিকা ফোট-ফোট হইয়াছিল, চক্ষের চাহনী চঞ্চল অথচ ভীত হইয়া আসিয়াছিল—উচ্চহাস্ত মৃদ্ধ এবং ব্রীড়াযুক্ত হইয়া উঠিয়াছিল—দ্রুত গতি মন্থর হইয়া আসিতে ছিল । আমি মনে করিতাম, এমন সৌন্দর্য্য কখন দেখি নাই—এ সৌন্দৰ্য্য যুবতীর অদৃষ্টে কখন ঘটে না ! বস্তুতঃ অতীত শৈশব অথচ অপ্রাপ্তযৌবনার সৌন্দর্য্য এবং অস্ফুটবাক্ শিশুর সৌন্দৰ্য্য— ইহাই মনোহর ; যৌবনের সৌন্দর্য্য তাদৃশ নহে। যৌবনে বসন-ভূষণের ঘটী, হাসি চাহনীর ঘটা—বেণীর দোলনি, বাহুর বলনি, গ্রীবার হেলনী, কথার ছলনি —যুবতীর রূপের বিকাশ এক প্রকার দোকানদারি । আর আমরা যে চক্ষে সে সৌন্দর্য্য দেখি, তাহাও বিকৃত। যে সৌন্দর্য্যের উপভোগে ইন্দ্রিয়ের সহিত সম্বন্ধযুক্ত চিত্তভাবের সংস্পর্শমাত্র নাই, সেই সৌন্দৰ্য্যই সৌন্দর্য্য । এই সময়ে আমাদের কুলকলঙ্ক কন্যাকৰ্ত্তার কর্ণে প্রবেশ করিল । সম্বন্ধ ভাঙ্গিয়া গেল। আমার হৃদয়পতত্রী সবে এই লবঙ্গলতায় বসিতেছিল—এমত সময় ভবানীনগরের রামসদয় মিত্র আসিয়া লবঙ্গলতী ছিড়িয়া লইয়া গেল। তাহার সঙ্গে লবঙ্গলতার বিবাহ হইল, লবঙ্গলাভে নিরাশ হুইয়া আমি বড় ক্ষুণ্ণ হইলাম । ইহার কয় বৎসর পরে এমন একটি ঘটনা ঘটিল যে, তাহা আমি বলিতে পারিতেছি না। পশ্চাৎ বলিব কি না, তাহাও স্থির করিতে পারিতেছি না। সেই অবধি আমি গৃহত্যাগ করিলাম। সেই পৰ্য্যস্ত নানা দেশ ভ্রমণ করিয়াই বেড়াই, কোথাও স্থায়ী হইতে পারি নাই।