পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/২৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

>bo চতুর্থ পরিচ্ছেদ কিছু কাম্য কি খুজিয়া পাই নাই ? এই অনন্ত সংসার অসংখ্য রত্নরাজিময়, ইহাতে আমার প্রার্থনীয় কি কিছুই নাই ? যে সংসারে এক একটি দুরবেক্ষণীয় ক্ষুদ্রকীট-পতঙ্গ অনন্ত কৌশলের স্থান, অনস্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার, যে জগতে পথিস্থ বালুকার এক এক কণা অনস্ত-রত্নপ্রভব নগাধিরাজের ভগ্নাংশ, সে জগতে কি আমার কাম্যবস্তু কিছুই নাই ? দেখ, আমি কোন ছাঁর ! টিণ্ডল, হক্সলী, ডার্বিন এবং লায়ল এক আসনে বসিয়া যাবজ্জীবনে ঐ ক্ষুদ্র নীহারবিন্দুর, ঐ বালুকাকণার বা ঐ শিয়ালকাটাফুলটির গুণ বর্ণনা করিয়া উঠিতে পারেন ন-তবু আমার কাম্যবস্তু নাই ? অামি কি ? দেখ, এষ্ট পৃথিবীতে কত কোটি মনুষ্য আছে, তাহা কেহ গণিয়া সংখ্যা করে নাই । বহু কোটি মনুষ্য সন্দেহ নাই। উহার একটি মনুষ্য অসংখ্য গুণের আধার । সকলেষ্ট ভক্তি, প্রীতি, দয়া, ধৰ্ম্মাদির আাধার—সকলেই পুঞ্জ্য, সকলেই অনুসরণীয়। আমার কাম্য কি কেহ নাই ? আমি কি ? আমার এক বাঞ্ছনীয় পদার্থ ছিল—আজিও আছে । কিন্তু সে বাসন পুর্ণ হইবার নহে। পূর্ণ হইবার নহে বলিয়া তাহা হৃদয় হইতে অনেক দিন হইল উন্মলিত করিয়াছি । আর পুনরুজ্জীবিত করিতে চাহি না । অন্য কোন বাঞ্ছনীয় কি সংসারে নাই ? তাই খুজি । কি করিব ? কয় বৎসর হইতে আমি আপন! আপনি এই প্রশ্ন করিতেছিলাম, উত্তর দিতে পারিতে ছলাম না । যে দুই এক জন বন্ধুবান্ধব আছেন, তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলে বলিতেন, “তোমার আপনার কাজ না থাকে, পরের কাজ কর । লোকের যথাসাধ্য উপকার কর ।” সে ত প্রাচীন কথা । লোকের উপকার কিসে হয় ? রামের মা'র ছেলের জর হইয়াছে, নাড়ী টিপিয়৷ একটু কুইনাইন দাও । রবো পাগলের গাত্রবস্ত্র নাই, কম্বল কিনিয়া দাও । সস্তার মা বিধবt, মাসিক দাও । সুন্দরনাপিতের ছেলে ইস্কুলে পড়িতে পায় না—তাহার বেতনের আমুকুল্য কর । এই কি পরের উপকার ? মানিলাম, এই পরের উপকার । কিন্তু এ সকলে কতক্ষণ যায় ? কতটুকু সময় কাটে ? কতটুকু পরিশ্রম হয় ? মানসিক শক্তি-সকল কতখানি বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী উত্তেজিত হয় ? আমি এমত বলি না ষে, এই সকল কাৰ্য্য আমার যথাসাধ্য আমি করিয়া থাকি ; কিন্তু যতটুকু করি, তাহাতে আমার বোধ হয় না যে, ইহাতে আমার অভাবপূরণ হইবে । আমার যোগ্যকাজ আমি খুজি ; ষাহাতে আমার মন মজিবে, তাই খুজি । আর একপ্রকারে লোকের উপকারের ঢং উঠিয়াছে । তাহার এক কথায় নাম দিতে হইলে বলিতে হয়, "বকবিকি লেখালেখি ” সোসাইট, ক্লব, এসোসিয়েসন, সভা, সমাজ, বক্তৃতা, রিজলিউশন, আবেদন, নিবেদন, সমবেদন—অামি তাহাতে নহি । আমি একদা কোন বন্ধুকে একটি মহাসভায় ঐক্লপ একখানি আবেদন পড়িতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম যে, “কি পড়িতেছ?” তিনি বলিলেন, "এমন কিছু না, কেবল কাণ ফকির ভিক মাঙ্গে !” এ সকল আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে তাই—কেবল “কণী ফকির ভিক মাঙ্গে রে বাবা।” এই রোগের আর এক প্রকার বিকার আছে । বিধবার বিবাহ দাও, কুলীন ব্রাহ্মণের বিবাহ বদ্ধ কর, অল্প বয়সে বিবাহ বন্ধ কর, জাতি উঠাইয়া দাও, স্ত্রীলোকগণ এক্ষণে গোরুর মত গোয়ালে বাধা থাকে-- দড়ি খুলিয়া তাহাদিগকে ছাড়িয়া দেও, চরিয়া খাক । আমার গোরু নাই । পরের গোয়ালের সঙ্গেও আমার বিশেষ সম্বন্ধ নাই । জাতি উঠাইভে আমি বড় রাজি নহি, আমি ততদুর আজও স্বশিক্ষিত হই নাই। আমি এখনও আমার ঝাড়ুদারের সঙ্গে একত্রে বলিয়৷ থাইতে অনিচ্ছুক, তাহার কন্যা বিবাহ করিতেও অনিচ্ছুক এবং যে গালি, শিরোমণি মহাশয় দিলে নিঃশব্দে সহিব, ঝাড়ুদারের কাছে তাহ সহিতে অনিচ্ছুক । সুতরাং আমার জাতি থাকুক। বিধবা বিবাহ করে করুক, ছেলেপুলের আইবুড় থাকে থাকুক, কুলীন ব্রাহ্মণ এক পত্নীর যন্ত্রণায় খুগ্ৰী হয় হউক, আমার আপত্তি নাই ; কিন্তু তাহার পোবকতায় লোকের কি হিত হইবে, তাহ। আমার বুদ্ধির অতীত । সুতরাং এ বঙ্গসমাজে আমার কোন কাৰ্য্য নাই । এখানে আমি কেহ নহি-আমি কোথাও নছি । আমি-আমি, এই পৰ্য্যন্ত, আর কিছু নছি। আমার সেই দুঃখ । আর কিছু দুঃখ নাই—লবঙ্গলতার হস্তলিপি ভুলিয়া যাইতেছি । -