পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

·ණිස “অনুগ্রহ করিয়া আমার বিপদ শ্রবণ করুন। আমার বদূষ্টক্রমে দিল্লীর বাদশাহ আমার পাণিগ্রহণ করিতে মানস করিয়াছেন । অনতিবিলম্বে তাহার সৈন্য আমাকে দিল্লী লইয়া যাইবার জন্য আসিবে । আমি রাজপুতকস্তা, ক্ষত্রিয়কুলোদ্ভব – কি প্রকারে তাহীদের দাসী হইব ? রাজহংসী হইয়৷ কেমন কবির বকসহচরী হইব ? হিমালয়নন্দিনী হইয়া কি প্রকারে পঙ্কিণ তড়াগে মিশাইব ? রাজকুমারী হইয়। কি প্রকারে তুরকীবৰ্ব্বরের আজ্ঞাকারিণী হইব ? আমি স্থির করিয়াছি, এ বিবাহের অগ্ৰে বিষভোজনে প্রাণত্যাগ করিব ! “মহারাজাধিরাজ ! আমাকে অহঙ্কু তা মনে করিবেন না। আমি জানি যে, আমি ক্ষুদ্র ভূম্যধি'কারীর ক্যা-যোধপুর, অম্বর প্রভৃতি দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজাধিরাজগণও দিল্লীর বাদশাহকে কস্তাদান করা কলঙ্ক মনে করেন না-কলঙ্ক মনে করা দূরে থাক্, বরং গৌরব মনে করেন । আমি সে সব ঘরের কাছে কোন ছার! আমার এ অহঙ্কার কেন, এ কথ। আপনি জিজ্ঞাসা করিতে পারেন ; কিন্তু মহারাজ ! স্থৰ্য্যদেব অস্ত গেলে খদ্যোত কি জলে না ? শিশিরভরে নলিনী মুদ্রিত হইলে ক্ষুদ্র কুন্দকুসুম কি বিকসিত হয় না ? যোধপুর অম্বর কুলধ্বংস করিলে রূপনগরে কি কুলরক্ষা হইতে পারে না ? মহারাজ, ভাটমুখে শুনিয়াছি যে,— বনবাসী রাণ। প্রতাপের সহিত মহারাজ মানসিংহ ভোজন করিতে আসিলে মহারাণ। ভোজন করেন নাই, বলিয়ছিলেন, যে তুর্ককে ভগিনী দিয়াছে, তাহার সহিত ভোজন করিব না । সেই মহাবীরের বংশধরকে কি আমায় বুঝাইতে হইবে যে, এই সম্বন্ধ রাজপুতকুলকামিনীর পক্ষে ইহলোক-পরলোকে ঘূণাস্পদ ? মহারাজ ! আজিও আপনার বংশে তুর্ক বিবাহ করিতে পারিল না কেন ? আপনার বীৰ্য্যবান মহাবল পরাক্রান্ত বংশ বটে, কিন্তু তাই বলিয়া নহে। মহাবলপরাক্রাস্ত রুমের বাদশাহ কিংবা পারস্তের শাহ দিল্লীর বাদশাহকে কন্যাদান গৌরব মনে করেন । তবে উদয়পুরেশ্বর কেবল তাহাকে কন্যাদান করেন না কেন ? তিনি রাজপুত বলিয়া। আমিও সেই রাজপুত । মহারাজ ! প্রাণত্যাগ করিব, তবু কুল রাখিব প্রতিজ্ঞ করিয়াছি ।

  • প্রয়োজন হইলে প্রাণবিসর্জন করিব, প্রতিজ্ঞ করিয়াছি ; কিন্তু তথাপি এই অষ্টাদশ বৎসর বয়সে এ অভিনব জীবন রাখিতে বাসন। হর । কিন্তু কে

বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী এ বিপদে এ জীবন রক্ষা করিবে ? অামার পিতার, ত কথাই নাই, তাহার এমন কি সাধ্য যে, আলমৃগীরের সঙ্গে বিবাদ করেন ? আর যত রাজপুত রাজ ছোট হউন, বড় হউন, সকলেই বাদশাহের ভৃত্য—সকলেই বাদশাহের ভয়ে কম্পিতকলেবর। কেবল আপনি–রাজপুতকুলের এক প্রদীপ—কেবল আপনিই স্বাধীন, কেবল উদয়পুরেশ্বরই বাদশাহের সমকক্ষ। হিন্দুকুলে আর কেহ নাই—যে এই বিপন্ন বালিকাকে রক্ষা করে । আমি আপনার শরণ লইলাম—আপনি কি আমাকে রক্ষা করিবেন না ? “কত বড় গুরুতর কাৰ্য্যে আমি আপনাকে অনুরোধ করিতেছি, তাহা আমি না জানি, এমন নহে । আমি কেবল বালিকা-বুদ্ধির বশীভূত হইয় লিখিতেছি, এমত নহে । দিল্লীশ্বরের সহিত বিবাদ সহজ নহে, জানি । এ পৃথিবীতে আর কেহই নাই যে, তাহার সঙ্গে বিবাদ করিয়া তিষ্ঠিতে পারে । কিন্তু মহারাজ, মনে করিয়া দেখুন, মহারাণা সংগ্ৰামসিংহ বাবর শাহকে প্রায় রাজ্যচুতি করিয়াছিলেন । মহারাণ। প্রতাপসিংহ আকৃবরশাহকেও মধ্যদেশ হইতে বহিস্কৃত করিয়া দিয়াছিলেন । আপনি সেই সিংহাসনে আসীন-আপনি সেই সংগ্রামের, সেই প্রতাপের বংশধর –আপনি কি তাহাদিগের অপেক্ষা হীনবল ? শুনিয়াছি না কি মহারাষ্ট্রে এক পাৰ্ব্বতীয় দস্থ্য আলমৃগীরকেট পরাভূত করিয়াছে—সে আলমগীর কি রাজস্থানের রাজেন্দ্রের কাছে গণ্য ? “আপনি বলিতে পারেন, আমার বাহুতে বল আছে, কিন্তু থাকিলেও আমি তোমার জন্য কেন এত কষ্ট করিব ? আমি কেন অপরিচিত মুখরা কামিনীর জন্য প্রাণিহত্যা করিব ? ভীষণ সমরে অবতীর্ণ হুইব ? মহারাজ ! সৰ্ব্বস্ব পণ করিয়া শরণাগতকে রক্ষা করা কি রাজধৰ্ম্ম নহে ? সৰ্ব্বস্ব পণ করিয়া কুলকামিনীর রক্ষা কি রাজপুতের ধৰ্ম্ম নহে ?” এই পৰ্য্যস্ত পত্ৰখানি রাজকন্যার হাতের লেখা, বাকি যেটুকু, সেটুকু তাহার হাতের নহে। নিৰ্ম্মলকুমারী লিখিয়া দিয়াছিল ; রাজকন্যা তাহ জানিতেন কি না, আমরা বলিতে পারি না । সে কথা এই— “মহারাজ ! আর একটি কথা বলিতে লজ্জা করে, কিন্তু না বলিলেও নহে । আমি এই বিপদে পড়িয়া পণ করিয়াছি ষে, যে বীর আমাকে মোগলহস্ত হইতে রক্ষা করিবেন, তিনি যদি রাজপুত হয়েন, আর যদি আমাকে যথাশাস্ত্র গ্রহণ করেন, তবে আমি র্তাহার দাসী হইব । হে বীরশ্রেষ্ঠ ! যুদ্ধে স্ত্রীলাভ