পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজসিংহ অনুরাগিণী হইতে পারিবে কি না, আমার মনে এই সকল সংশয় ছিল । সে সকল সংশয় আজিকার কথাবার্তায় দূর হইয়াছে। তুমি আমার মহিষী হইবে । তবে একটা কথার অপেক্ষা করিতে চাই । তোমার পিতার মত হইবে কি ? তাহার অমতে আমি বিবাহ করিতে চাহি না"। তাহার কারণ, যদিও তোমার পিতার ক্ষুদ্র রাজ্য এবং র্তাহার সৈন্ত অল্প, কিন্তু বিক্রম শোলাঙ্কি যে একজন বীরপুরুষ এবং উপযুক্ত সেনানায়ক, ইহা প্রসিদ্ধ। মোগলের সঙ্গে আমার যুদ্ধ বাধিবেই বাধিবে। বাধিলে তাহার সাহায্য আমার পক্ষে বিশেষ মঙ্গলজনক হইবে । র্তাহার অনুমতি লইয়া বিবাহ না . করিলে তিনি কখনও আমার সহায় হইবেন না। বরং তার অমতে বিবাহু করিলে তিনি মোগলের সহায় এবং আমার শক্র হইতে পারেন। তাহা বাঞ্ছনীয় নহে, অতএব আমার ইচ্ছ, তাহাকে পত্র লিখিয়া, তাহার সম্মতি অনাইয়া তোমাকে বিবাহ করি। তিনি সম্মত হইবেন কি ? চঞ্চল। ন হইবার ত কোন কারণ দেখি না। আমার ইচ্ছা, পিতা-মাতার আশীৰ্ব্বাদ লষ্টয়াই আপনার চরণসেবাব্রত গ্ৰহণ করি । লোক পাঠান আমারও ইচ্ছা। তখন রাঞ্জসিংহ একখানি সবিনয় পত্র লিখিয়া বিক্রম শোলাঙ্গির নিকট দূত প্রেরণ করিলেন। চঞ্চলকুমারীও মাতার আশীৰ্ব্বাদ কামনা করিয়া একখানা পত্র লিখিলেন । -** তৃতীয় পরিচ্ছেদ অগ্নি জালিবার প্রয়োজন রূপনগরের অধিপতির উত্তর, উপযুক্ত সময়ে পৌছিল । উত্তর বড় ভয়ানক। তাহার মৰ্ম্ম এই ; — রাজসিংহকে তিনি লিখিতেছেন, “আপনি রাজপুতানার মধ্যে সৰ্ব্বপ্রধান। রাজপুতানার মুকুটস্বরূপ । এক্ষণে আপনি রাজপুতের নামে কলঙ্ক দিতে প্রস্তুত। আপনি বলপুৰ্ব্বক আমার অপমান করিয়া আমার কন্যাকে হয়ণ করিয়াছেন। আমার কন্যা পৃথিবীশ্বরী হুইত, আপনি তাহাতে বাদ সাধিয়াছেন। আপনারও শক্ৰতা করা আমার কৰ্ত্তব্য আমার সম্মতিক্রমে আপনি আমার কন্যার পাণিগ্রহণ করিতে পারিবেন না । "আপনি বলিতে পারেন, সেকালে ক্ষত্রিয়-বীরেরা কন্যা হরণ করিয়া বিবাহ করিতেন। ভীষ্ম, অৰ্জুন, අද් স্বয়ং শ্ৰীকৃষ্ণ কন্যা-হরণ করিয়াছিলেন । কিন্তু আপনার সে বলবীৰ্য্য কৈ ? আপনার বাহুতে যদি বল আছে, তবে হিন্দুস্থানে মোগল বাদশাহ কেন ? শৃগাল হইয়৷ সিংহের অনুকরণ করা কর্তব্য নহে। আমিও রাজপুত, মুসলমানকে কন্যা দান করিলে আমার গৌরব বৃদ্ধি পাইবে না, জানি । কিন্তু না দিলে মোগল রূপনগরের পাহাড়ের একখানি পাতরও রাখিবে না। যদি আমি আপনি আত্মরক্ষা করিতে পারিতাম, কি কেহ আমাকে রক্ষা করিবে জানিতাম, তবে আমিও ইহাতে সম্মত হইতাম না । যখন জানিব যে আপনার সে ক্ষমতা আছে, তখন না হয় আপনাকে কন্যাদান করিব । “সত্য বটে, পূৰ্ব্বকালে ক্ষত্রিয় রাজগণ কন্সাহরণ করিয়া বিবাহ করিতেন, কিন্তু এমন চাতুরী, মিথ্যা প্রবঞ্চনা কেহই করিতেন না । আপনি আমার কাছে লোক পাঠাইয়া মিথ্যা কথা বলিয়া, আমার সেনা লইয়া গিয়া, আমারই কন্যা হরণ করিলেন,— নচেৎ আপনার সাধ্য হয় নাই । ইহাতে আমার কতটা অনিষ্ট সাধিয়াছেন, তাহা বিবেচনা করিয়া দেখুন। মোগল বাদশাহ মনে করিবেন, যখন আমার সৈন্য যুদ্ধ করিয়াছে, তখন আমারই কুচক্রে আমার কন্যা অপহৃত হইয়াছে। অতএব নিশ্চয়ই আগে রূপনগর ধ্বংস করিয়া তবে আপনার দণ্ডবিধান করিবেন। আমিও যুদ্ধ করিতে জানি, কিন্তু মোগলের লক্ষ লক্ষ ফৌজের কাছে কার সাধ্য অগ্রসর হয় ? সেই জন্য প্রায় সকল রাজপুত তাহার পদানত হইয়া আছে -আমি কোন ছার। “জানি না, এখন তাহার কাছে সত্য কথা বলিয়া নিস্কৃতি পাইব কি না। কিন্তু আপনি যদি আমার কন্ত বিবাহ করেন, র্তাহাকে সে কন্যা দিবার আর যদি পথ না থাকে, তবে আমার বা আমার কন্যার নিস্কৃতির আর কোন উপায় থাকিবে না । “আপনি আমার কন্যা বিবাহ করিবেন না । করিলে আপনাদিগকে আমার শাপগ্ৰস্ত হইতে হইবে। আমি শাপ দিতেছি যে, তাহা হইলে আমার কন্যা বিধবা, সহগমনে বঞ্চিত, মৃতপ্রজা এবং চিরদুঃখিনী হইবে, এবং আপনার রাজধানী শৃগালকুকুরের বাসভূমি হইবে।” - বিক্রম শোলাঙ্কি এই ভীষণ অভিসম্পাতের পর নীচে এক ছত্র লিখিয়া দিলেন, “যদি আপনাকে কখনও উপযুক্ত পাত্র বিবেচনা করিবার কারণ পাই, তবে ইচ্ছাপূৰ্ব্বক আমি আপনাকে কন্যাদান করিব।”