পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૭8 নিৰ্ম্মল শাহান শাহ ! আপনি কখনও কি শুনেন নাই যে, হিন্দু স্ত্রীলোকের ব্রত নিয়ম করে ? ত্ৰত নিয়ম জন্ত এক দিন, দুই দিন, তিন দিন নিরন্থ উপবাস করে ? শুনেন নাই, শরণাধবৃণার জন্য অনিয়মিত কাল উপবাস করে ? শুনেন নাই, তারা কখন কখন উপবাস করিয়া ইচ্ছাপূৰ্ব্বক প্রাণত্যাগ করে ? জাহাপন ! এ দাসীও তা পারে ৷ ইচ্ছা হয়, আমার মৃত্যু পৰ্য্যন্ত পরীক্ষা করিয়া দেখুন। ঔরঙ্গজেব দেখিলেন, এ মেয়েকে ভয় দেখাইয়া কিছু হুইবে না, মারিয়। ফেলিলেও কিছু হইবে না । পীড়ন করিলে কি হয় বলা যায় না । কিন্তু তার পূৰ্ব্বে একবার প্রলোভনের শক্তিটা পরীক্ষা করা ভাল । অতএব বলিলেন, “ভাল, নাই তোমাকে পীড়ন করিলাম । তোমাকে ধন দৌলত দিয়া বিদায় করিব । তুমি এ সকল কথা আমার নিকট যথার্থ প্রকাশ কর " নিৰ্ম্মল । রাজপুতকন্যা যেমন মৃত্যুকে ঘৃণা করে, ধনদৌলতকেও তেমনই । সামান্য স্ত্রীলোক আমি —নিজ গুণে আমাকে বিদায় দিন । ঔরঙ্গ। দিল্লীর বাদশাহের আদেয় কিছু নাই । তাহার কাছে প্রার্থনীয় তোমার কি কিছুই নাই ? নি । আছে । নিৰ্ব্বিঘ্নে বিদায় । ঔরঙ্গ । কেবল সেইটি এখন পাইতেছ না । তা ছাড়া আর জগতে তোমার প্রার্থনা করিবার কি ভয় করিবার কিছু নাই ? নি। প্রার্থনার আছে বৈ কি । কিন্তু দিল্লীর বাদশাহের রত্নাগারে সে রত্ন নাই । ঔরঙ্গ । এমন কি সামগ্ৰী ? নি । আমরা হিন্দু, আমরা জগতে কেবল ধৰ্ম্মকেই ভয় করি, ধৰ্ম্মই কামনা করি । দিল্লীর বাদশাহ ম্লেচ্ছ আর দিল্লীর বাদশাহ ঐশ্বৰ্য্যশালী । দিল্লীর বাদশাহের সাধ্য কি ষে, আমার কাম্যবস্তু দিতে পারেন, কি লইতে পারেন ? দিল্লীশ্বর নিৰ্ম্মলকুমারীর সাহস ও চতুরতা দেখিয়া, ক্রোধ পরিত্যাগ করিয়া, বিস্ময়াবিষ্ট হইয়াছিলেন, কিন্তু এই কটুক্তিতে পুনৰ্ব্বার ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, “বটে ! বটে। ঐ কথাটা ভুলিয়া গিয়া ছিলাম * তখন তিনি এক জন তাতারীকে আদেশ করিলেন, “যা, বাবুচ্চিমহাল হইতে কিছু গোমাংস আনিয়া, দুই তিন জনে ধরিয়া ইহার মুখে গুজিয়া দে * নিৰ্ম্মল তাহাতেও টলিল না, বলিল, “জানি, আপনাদিগের সে বিদ্যা আছে । সে বিদ্যার জোরেই বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী এই সোণার হিন্দুস্থান কাড়িয়া লইয়াছেন। জানি, গোরুর পাল সম্মুখে রাখিয়া লড়াই করিয়াই মুসলমান হিন্দুকে পরাস্ত করিষাছে—নহিলে রাজপুতের বাহুবলের কাছে মুসলমানের বাহুবল, সমুদ্রের কাছে গোপদ । কিন্তু আবার একটা কথা আপনাকে মনে করিয়া দিতে হইল। শুনেন নাই কি যে, রাজপুতের মেয়ে বিষ সঙ্গে না লইয়া এক পা চলে না ? আমার নিকটে এমন তীব্র বিষ আছে যে, আপনার ভৃত্যগণ গোমাংস লইয়৷ এই ঘরে পা দেওয়ার পরেও যদি আমি তাহা মুখে দিই, তবে জীবন্তে আর আমার মুখে কেহ গোমাংস দিতে পারিবে না। জাহাপনা ! আপনার বড় ভাই দীর শেকোকে বধ করিয়া তাহার দুইট কবিলা কাড়িয়া আনিতে গিয়াছিলেন —পারিয়াছিলেন কি ? — অধম খৃষ্টিয়ানীটা আসিয়াছিল জানি, রাজপুতনী দিল্লীর বাদশাহের মুখে সাত পয়জার মারিয়া স্বৰ্গে চলিয়া ষায় নাই কি ? আমিও এখনই তোমার মুখে সাত পয়জার মারিয়া স্বর্গে চলিয়া যাইব ।” বাদশাহ বাক্যশূন্ত । যিনি পৃথিবীপতি বলিয়৷ বিখ্যাত, পৃথিবীময় যাহার গৌরব ঘোষিত, যিনি সমস্ত ভারতবর্ষের ত্রাস, তিনি আজ এই অনাথ নিঃসহায় অবলার নিকট অপমানিত – পরাস্ত । ঔরঙ্গজেব পরাজয় স্বীকার করিলেন । মনে মনে বলিলেন, “এ অমূল্য রত্ন, ইহাকে নষ্ট করা হইবে না । আমি ইহাকে বশীভূত করিব।” প্রকাশ্বে অতি মধুরস্বরে বলিলেন, “তোমার নাম কি পিয়ারি ?” নিৰ্ম্মলকুমারী হাসিয়া বলিল, “ও কি জাহাপনা ! আরও রাজপুত-মহিষীতে সাধ আছে না কি ? তা সে সাধও পরিত্যাগ করিতে হুইতেছে । আমি বিবাহিতা, আমার হিন্দু স্বামী জীবিত আছেন।” ওঁ । সে কথা এখন থাকৃ। এখন তুমি কিছু দিন আমার এই রঙমহালমধ্যে বাস কর । এ হুকুম বোধ করি তুমি অমান্য করিবে না ? নিঃ । কেন আমাকে আটক করিতেছেন ? ঔ । তুমি এখন দেশে গেলে আমার বিস্তর নিন্দ করিবে । যাহাতে তুমি আমার প্রশংসা করিতে পার, এক্ষণে তোমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করিব । পরে তোমাকে ছাড়িয়া দিব । নি। যদি আপনি না ছাড়েন, তবে আমার যাইবার সাধ্য নাই । কিন্তু আপনি কয়েকটি কথা প্রতিশ্রত হইলেই আমি দিন কত থাকিতে পারি। ঔ । কি কি কথা ? নি। হিন্দুর অন্নজল ভিন্ন আমি স্পর্শ করিব না।