পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজসিংহ এ সব কথা লইয়া যোধপুরীর সঙ্গে নিৰ্ম্মলের আন্দোলন হইত। একদা হাসিয়া নিৰ্ম্মল যোধপুরীকে বলিল,— সোণে কি পিঞ্জিরা সোণে কি চিড়িয়া সোণে কি জিঞ্জির পয়ের মে, সোণে কি চান, সোণে কি দানা, মটি কেও সেরেফ খয়ের মে । যোধপুর জিজ্ঞাসা করিল, “তুই নিস কেন ?” নিৰ্ম্মল বলিল, “উদয়পুরে গিয়া দেখাইব যে, মোগল-বাদশাহকে ঠকাইয়ু আনিয়াছি।” জেবউগ্লিস ঔরঙ্গজেবের দাহিন হাত । ঔরঙ্গজেবের আদেশ পাইয়া, জেব-উল্লিস। নিৰ্ম্মলকে লইয়া পড়িলেন । আসল কাজটা শাহজাদীর হাতে রহিল –বাদশাহ নিজে মধুর আলাপের ভারটুকু আপন হাতে রাখিলেন । নিৰ্ম্মলের সঙ্গে রঙ্গরসিকতা করিতেন, কিন্তু তাহাও একটু বাদশাহ রকমের মাজঘষা থাকি ভ—নিৰ্ম্মল রাগ করিতে পারিত না, কেবল উত্তর করিত, তাও মেয়েলী রকম মাজা-ঘষা, তবে রূপনগরের পাহাড়ের কর্কশতা শুষ্ঠ নহে ৷ এখনকার ইংরেজী রুচির সঙ্গে ঠিক মিলিবে না বলিয়া সেই বাদশাহী রুচির উদাহরণ দিতে পারিলাম না । জেব-উন্নিসার কাছে নিৰ্ম্মলের যাহা বলিবার আপত্তি নাই, তাহা সে অকপটে বলিয়াছিল । অন্যান্ত কথার মধ্যে রূপনগরের যুদ্ধটা কি প্রকারে হইয়াছিল, সে কথাও পাড়িয়াছিল। নিৰ্ম্মল যুদ্ধের প্রথমভাগের কিছু দেখে নাই, কিন্তু চঞ্চলকুমারীর কাছে সে সকল কথা শুনিয়াছিল । যেমন শুনিয়াছিল, জেবাউন্নিসাকে তেমনই শুনাইল । মবারক যে মোগল সৈন্যকে ডাকিয়া, চঞ্চলকুমারীর কাছে পরাভব স্বীকার করিয়া, রণজয় ত্যাগ করিতে বলিয়াছিল, তাহা বলিল, চঞ্চলকুমারী যে রাজপুতগণের রক্ষার্থ ইচ্ছাপূৰ্ব্বক দিল্লীতে আসিতে চাহিয়াছিল, তাহাও বলিল, বিষ খাইবার ভরসার কথাও বলিল, মবারক যে চঞ্চলকুমারীকে লইয়া আসিল না, তাহাও বলিল । শুনিয়া জেবাউন্নিসা মনে মনে বলিলেন, “মবারক সাহেব ! এই অস্ত্রে তোমার কাধ হইতে মাথ৷ নামাইব ।” উপযুক্ত অবসর পাইলে, জেব-উল্লিস ঔরঙ্গজেবকে যুদ্ধের সেই ইতিহাস শুনাইলেন । ঔরঙ্গজেব শুনিয়া বলিলেন, “যদি সে নফর এমন বিশ্বাসঘাতক হয়, তবে আজি সে জাহান্নামে যাইবে ।” ঔরঙ্গজেব কাণ্ডটা না বুঝিলেন, তাহা নহে। জেবউল্লিসার কুচরিত্রের কথা তিনি সৰ্ব্বদাই শুনিতে ♥ፋ পাইতেন । কতকগুলি লোক আছে, এ দেশের লোকে তাহাদের বর্ণনার সময় বলে, “ইহার কুকুর মারে, কিন্তু হাড়ি ফেলে না 7 মোগল-বাদশাহেরা সেই সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন । র্তাহারা কন্যা বা ভগিনীত্ব দুশ্চরিত্র জানিতে পারিলে কন্যা কি ভগিনীকে কিছু বলিতেন না, কিন্তু যে ব্যক্তি কন্যা বা ভগিনীর অমুগৃহীত, তাহার ঠিকান পাইলেই কোন ছলে কৌশলে তাহার নিপাতসাধন করিতেন । ঔরঙ্গজেব অনেক দিন হইতে মবারককে জেব-উল্লিসার প্রতিভাজন বলিরা সন্দেহ করিয়া আসিতেছিলেন, কিন্তু এ পর্য্যস্ত ঠিক বুঝিতে পারেন নাই। এখন কন্যার কথায় ঠিক বুঝিলেন, বুঝি কলহ ঘটিয়াছে, তাই বাদশাহজাদী, যে পিপীলিকা তাহাকে দংশন করিয়াছে, তাহাকে টিপিয়া মারিতে চাহিতেছেন । ঔরঙ্গজেব তাহাতে খুব সম্মত। কিন্তু একবার নিৰ্ম্মলের নিজমুখে এ সকল কথা বাদশাহের শুনা কৰ্ত্তব্য বোধে, তিনি নিৰ্ম্মলকে ডাকাইলেন । ভিতরের কথা নিৰ্ম্মল কিছু জানে না, বা বুঝিল না, সকল কথাই ঠিক বলিল । যথাবিহিত সময়ে বখশীকে তলব করিয়া, বাদশাহ মবারকের সম্বন্ধে আজ্ঞাপ্রচার করিলেন । বখশীর আজ্ঞা পাইয়া আট জন আহুদী গিয়া মৰারককে ধরিয়া আনিয়া বখশীর নিকট হাজির করিল। মবারক হাসিতে হাসিতে বখশীর নিকট উপস্থিত হইলেন । দেখিলেন, বখশীর সম্মুখে দুইটি লৌহপিঞ্জর । তন্মধ্যে একটি একটি বিষধর সর্প গর্জন করিতেছে । এখনকার দিনে যে রাজদণ্ডে প্রাণ হারায়, তাহাকে ফঁাসি বাইতে হয়, অন্য প্রকার রাজকীয় বধোপায় প্রচলিত নাই । মোগলদিগের রাজ্যে এরূপ অনেক প্রকার বধোপায় প্রচলিত ছিল । কাহারও মস্তকচ্ছেদ হইত ; কেহ শূলে যাইত ; কেহ হস্তিপদতলে নিক্ষিপ্ত হইত ; কেহ বা বিষধর সপের দংশনে প্রাণত্যাগ করিত । ষাহাকে গোপনে বধ করিতে হইবে, তাহার প্রতি বিষ-প্রয়োগ হইত । মবারক সহাস্তবদনে বখশীর কাছে উপস্থিত হইয়া এবং দুই পাশ্বে দুইটি বিষধর সৰ্পের পিঞ্জর দেখিয়া পূৰ্ব্ববৎ হাসিয়া বলিল, “কি, আমায় যাইতে হুইবে ?” বখশী বিষণ্ণভাবে বলিল, “বাদশাহের হুকুম ” মবারক জিজ্ঞাসা করিল, “কেন এ হুকুম হইল, কিছু প্রকাশ পাইয়াছে কি ?” বখশী । না—আপনি কিছু জানেন না ?