রাজসিংহ আমার ভাগ্যবশতঃই অবিবাহিত অবস্থায় আপনার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় নাই । আমি যে দীনদরিদ্রকে স্বামিত্বে বরণ করিয়াছি, སྨྲ་བ་ཚེ་ আমি সুখী । এক্ষণে আমায় বিদায় न । - ঔরঙ্গজেব দুঃখিত হইয়া বলিলেন, “জুনিয়ার বাদশাহ হইলেও কেহ সুখী হয় না—কাহারও সাধ মিটে না । এ পৃথিবীতে আমি কেবল তোমায় ভালবাসিয়াছি, কিন্তু তোমাকে পাইলাম না । তোমায় ভালবাসিয়াছি, অতএব তোমায় আটকাইব না— ছাড়িয়া দিব । তুমি যাহাতে সুখী হও, তাহাই করিব । যাহাতে তোমার দুঃখ হয়, তাহা করিব না । তুমি যাও । আমাকে স্মরণ রাখিও । যদি কখনও আম] হইতে তোমার কোন উপকার হয়, আমাকে জানাইও । আমি তাহা করিব।" নিৰ্ম্মল কুর্ণিশ করিল। বলিল, “আমার একটিমাত্র ভিক্ষ রহিল। যখন উভয় পক্ষের মঙ্গলার্থ সন্ধি করিতে আমি আপনাকে অনুরোধ করিব, তখন আমার কথায় কর্ণপাত করিবেন।” ঔরঙ্গজেব বলিল, “সে কথার বিচার সেই সময়ে इंद्देरब !' তখন নিৰ্ম্মল ঔরঙ্গজেবকে র্তাহার কপোত দেখাইলেন । বলিলেন, “এই শিক্ষিত পায়রা আপনি রাখিবেন । যখন এ দাসীকে আপনি স্মরণ করিবেন, এই পায়রাটি আপনি ছাড়িয়া দিবেন । ইহা দ্বারা আমার নিবেদন আপনাকে জানাইব । আমি এক্ষণে সৈন্সের সঙ্গেই রহিলাম। যখন আমার বিদায়ু লইবার সময় হইবে, বেগমসাহেবা যেন আমাকে বিদায় দেন, এই অমুমতি তার প্রতি - থাকৃ ” তখন ঔরঙ্গজেব সৈন্যচালনার ব্যবস্থা করিতে নিযুক্ত হইলেন । কিন্তু তাহার মনে বড় বিষাদ উপস্থিত হইল । নিৰ্ম্মলের মত কথোপকথনে সাহস, বাক্চাতুৰ্য্য এবং স্পষ্টবক্তৃত্ব মোগল বাদশাহ আর কোথাও দেখেন নাই । যদি কোন রাজা—শিবন্ধী বা রাজসিংহ, যদি কোন সেনাপতি—দিলীর কি তমুবার, যদি কোন শাহজাদ। --আজিম কি আকৃবর এরূণ সাহসে এরূপ স্পষ্ট কথা বলিত, ঔরঙ্গজেব তাছা সহ্য করিতেন না । কিন্তু রূপবতী যুবতী, সহায়হীন নিৰ্ম্মলের কাছে তাহ মিষ্ট লাগিত। বুড়ার উপর যতটুকু কন্দৰ্পের অত্যাচার হইতে পারে, বোধ হয়, তাহা হইয়াছিল। ঔরঙ্গজেব প্রেমান্ধের মত বিচ্ছেদে শোকে শোকাকুল না হইয়া ዓ¢ একটু বিষণ্ণ হইলেন মাত্র। ঔরঙ্গজেব মার্ক আস্তনি বা অগ্নিবর্ণ ছিলেন না, কিন্তু মনুষ্য কখন পাষাণও श्शू नl । তৃতীয় পরিচ্ছেদ বাদশাহ বহ্নিচক্রে প্রভাতে বাদশাহী সেনা কুচ করিতে আরম্ভ করিল। সৰ্ব্বাগ্রে পথপরিষ্কারক সৈন্য পথ পরিষ্কারের জন্য সশস্ত্রে ধাবিত । তাহাদের অস্ত্র কোদালি, কুড়ালি, দা ও কাটারি । তাহারা সম্মুখের গাছ সকল কাটিয়া, সরাইয়া, খানা-পয়গার বুজাইয়া, মাটী চাচিয়৷ বাদশাহী সেনার জন্ত প্রশস্ত পথ প্রস্তুত করিয়া অগ্ৰে অগ্ৰে চলিল। সেই প্রশস্ত পথে কামানের শ্রেণী, শকটের উপর আরূঢ় হইয়া ঘড়ঘড় হড় হড়, করিয়া চলিল –সঙ্গে গোলন্দাজ সেনা । অসংখ্য গোলন্দাজি গাড়ীর ঘড়ঘড় শব্দে কর্ণ বধির,—তাহার চক্রসহস্ৰ হইতে বিঘুর্ণিত উৰ্দ্ধোখিত ধুলিজালে নয়ন অন্ধ ; কালাস্তক যমের ন্যায় ব্যাদিতাস্ত কামানসকলের আকার দেখিয়া হৃদয় কম্পিত । এই গোলন্দাজ সেনার পশ্চাৎ রাজকোষাগার । বাদশাহী কোষাগার সঙ্গে সঙ্গে চলিত ; দিল্লীতে কাহাকেও বিশ্বাস করিয়া ঔরঙ্গজেব ধনরাশি রাখিয়া যাইতে পারিতেন না। ঔরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যশাসনের মূলমন্ত্ৰ সৰ্ব্বজনে অবিশ্বাস । ইহাও স্মরণ রাখা কৰ্ত্তব্য যে, এইবার দিল্লী হইতে যাত্রা করিয়া ঔরঙ্গজেব আর কখন দিল্লী ফিরিলেন না। শতাব্দীর একপাদ শিবিরে শিবিরে ফিরিয়া দাক্ষিণাত্যে প্রাণত্যাগ করিলেন । অনন্ত ধনরত্বরাজিপরিপূর্ণ গজাদিবাহিত রাজ কোষের পর বাদশাহী দফতরখানা চলিল । থাকে থাকে থাকে, গাড়ী, হাতী, উটের উপর সাজান খাতাপত্র বহিজাত ; সারির পর সারি, শ্রেণীর পর শ্রেণী ; অসংখ্য, অনন্ত, চলিতে লাগিল । তার পর গঙ্গাজল বাহী উটের শ্রেণী । গঙ্গাজলের মত সুপেয় কোন নদীর জল নহে, তাই বাদশাহদিগের সঙ্গে অৰ্দ্ধেক গঙ্গার জল চলিত । জলের পর আহাৰ্য্য—আটা, ঘৃত, চাউল, মশলা, শর্করা, নানাবিধ পক্ষী, চতুষ্পদ– প্রস্তুত, অপ্রস্তুত, পঙ্ক, অপঙ্ক, ভক্ষ্য চলিত। তার পর সঙ্গে সঙ্গে সহস্ৰ সহস্র বাবুর্চি। তৎপশ্চাৎ তোষাখানা —এলবাসপোষাকের, জেওরাতের হুড়াহুড়ি ছড়াছড়ি ; তার পর অগণনীয় অশ্বারোহী মোগলসেন ।
পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/৮০
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।