૧૭ এই গেল সৈন্তের প্রথম ভাগ । দ্বিতীয় ভাগে বাদশাহ খোদ । আগে আগে অসংখ্য উষ্ট্রশ্রেণীর উপর জলন্ত বহ্নিবাহী বৃহৎ কটাহসকলে ধূনা, গুগগুল, চন্দন, মৃগনাভি প্রভূতি গন্ধদ্রব্য । সুগন্ধে ক্রোশ ব্যাপিয়া পুথিবী ও অন্তরীক্ষ আমোদিত, তৎপশ্চাৎ বাদশাহী খাস আহদী সেনা, দোষ শূন্ত রমণীয় অশ্বরাজির উপর আরূঢ়, দুই পার্শ্বে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া চলিতেছে । মধ্যে বাদশাই নিজে মণিরত্নকিঙ্কিণীজালাদি শোভায় উজ্জল উচ্চৈঃশ্রব। তুল্য অশ্বের উপর আরূঢ়-শিরোপরি বিখ্যাত শ্বেতচ্ছত্র। তার পর সৈন্তের সার, দিল্লীর সার, বাদশাহীর সার ঔরঙ্গজেবের অবরোধবাসিনী সুন্দরাসম্প্রদায়। কেহ বা ঐরাবততুল্য গজপৃষ্ঠে, সুবর্ণ নিৰ্ম্মিত কারুকার্য্যবিশিষ্ট মখমলে মোড়, মুক্তাঝালরভূষিত অতিস্থম্ম লুতাতন্তু তুল্য রেশমী বস্ত্রে আবৃত হাওদার ভিতরে অতি ক্ষীণমেঘাবৃত উজ্জল পূর্ণচন্দ্রতুল্য জলিতেছে, রত্নমালাজড়িত কালভুজঙ্গীতুল্য বেণী পৃষ্ঠে ফুলিতেছে ; কৃষ্ণতার বৃহচ্চক্ষুর মধ্যে কালাগ্নিতুল্য কটাক্ষ খেলিতেছে ; উপরে কালো ক্রযুগ, নীচে স্বরূমার রেখা, তাহার মধ্যে সেই বিদ্যুদামবিস্ফুরণে, সমস্ত সৈন্ত বিশৃঙ্খল হইয়া উঠিতেছে ; মধুর, তামুলারস্ত অধরে মাধুর্য্যময়ী সুন্দরীকুল মধুর মধুর হাসিতেছে। এমন এক জন নয়, দুই জন নয় —হাতীর গায়ে হাতী, হাতীর পিছু হাতা, তার পিছু হাতী। সকলের উপরেই তেমনই হাওদা, সকল হাওদার ভিতর তেমনই সুন্দরী, সকল সুন্দরীর নয়নেই মেঘযুগলমধ্যস্থ বিদ্যুদামের ক্রীড়া ! কালে পৃথিবী আলো হইয়া গেল । কেহ বা কদাচিৎ দোলায় চলিল— দালার বাহিরে কিংখাপ, ভি ভরে জরদেtঞ্জী কামদার মখমল, উপরে মুক্তার ঝালর, রূপার দাণ্ডা, সোনার হাঙ্গর –তাহার ভিতর রত্নমণ্ডিতা সুন্দরী । যোধপুরী ও নিৰ্ম্মলকুমারী, উদিপুর ও জেব উল্লিস। ইহারা গজ-পৃষ্ঠে । উদিপুরী হাস্যময়ী । যোধপুরী অপ্রসন্না । নিৰ্ম্মলকুমারা রহস্যময়ী । জেব উল্লিস। গ্রীষ্মকালের উন্মুলিত লতার মত ছিন্নবিচ্ছিন্ন, পরিশুষ্ক, শীর্ণ, মৃত-কল্প। জেব-উগ্লিসা ভাবিতেছিল, “এ হাতিয়ার-লহরীমাঝে আমার ডুধিয়া মরিবার কি উপায় নাই ?” এই মনোমোহিনী বাহিনীর পশ্চাৎ কুটুম্বিনী ও দাসীবৃন্দ। সকলেই অশ্বারূঢ়া, লম্বিতবেণী, রক্তাধরা, বিদ্যুৎকটাক্ষ ; অলঙ্কারশিঞ্জিতে ঘোড়া সকল নাচিয়া উঠিতেছে । এই অশ্বারোহিণী বাহিনীও অতিশয় লোকমনোমোহিনী : ইহাদের পশ্চাতে বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী _: আবার গোলন্দাজ সেনা। কিন্তু ইহাদের কামান অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র । বাদশাহ বুঝি স্থির করিয়াছিলেন, কামিনীর কমনীয় কটাক্ষের পর আর বড় কামানের প্রয়োজন নাই । . তৃতীয় ভাগে পদাতি-সৈন্ত । তৎপশ্চাৎ দাসদাসী, মুটে, মজুর, নর্তকী প্রভৃতি বাজে লোক, খালি ঘোড়া, তাম্বুর রাশি এবং মোট-ঘাট । - যেমন ঘোরনাদে গ্রাম, প্রদেশ ভাসাইয়া—তিমিমকর-আবৰ্ত্তাদিতে ভয়ঙ্করী, বর্ষাবিপ্লাবিত স্রোতস্বতী, ক্ষুদ্র সৈকত ডুবাইতে যায়, তেমনই মহাকোলাহলে, মহাবেগে, এই পরিমাণরহিতা অসংখ্যেয়৷ বিস্ময়কর মোগলবাহিনী রাজসিংহের রাজ্য ডুবাইতে চলিল । কিন্তু হঠাৎ একটা প্রতিবন্ধক উপস্থিত হইল । যে পথে আকবর সৈন্য লইয়া গিয়াছিলেন, ঔরঙ্গজেবও সেই পথে সৈন্য লইয়া যাইতেছিলেন । অভিপ্রায় এই যে, আক্ব্বর শাহের সৈষ্ঠের সঙ্গে নিজ সৈন্য মিলিত করিলেন । মধ্যে যদি কুমার জয়সিংহের সৈন্য পান, তবে তাহাকে মাঝে ফেলিয়া টিপিয়া মারিধেন, পরে দৃষ্ট জনে উদয়পুর প্রবেশ করিয়া রাজ্যব্বংস করিবেন । কিন্তু পাৰ্ব্বত্যপথে আরোহণ করিবার পূৰ্ব্বে সবিস্ময়ে দেখিলেন যে, রাজসিংহ উদ্ধে, পৰ্ব্বতের উপত্যকায় তাহার পথের প্রশ্বে সৈন্য লইয়া বসিয়া আছেন । রাজসিংহ নয়ননাম গিরিসঙ্কটে পাৰ্ব্বত্য-পথ রোধ করিয়াছিলেন, কিন্তু অতি দ্রুতগামী দূতমুখে আক্ব্বরের সংবাদ শুনিয়া, রণপাণ্ডিহ্যের অদ্ভুত প্রতিভার বিকাশ করিয়া, আমিষলোলুপ শু্যেনপক্ষীর মত দ্রুতবেগে সেন সহিত পুৰ্ব্বপরিচিত পাৰ্ব্বত্যপথ অতিক্রম করিয়া এই গিরিসমুদেশ সসৈন্তে উপবিষ্ট হুইয়াছিলেন । - মোগল দেখিল, রাজসিংহের এই অদ্ভুত রণপাণ্ডিতে তাহাদিগের সৰ্ব্বনাশ উপস্থিত । কেন না, মোগলরা যে পথে যাইতেছিল, সে পথে আর চলিলে রাজসিংহকে পাশ্বে রাখিয়। যাইতে হয় ; শত্রুসৈন্যকে পাশ্বে রাখিয়া যাওয়ার অপেক্ষ বিপদ অল্পই আছে । পাশ্ব হইতে যে আক্রমণ করে, তাহাকে রণে বিমুখ করা যায় না, সেই জয়ী হইয়া বিপক্ষকে ছিন্ন-ভিন্ন করিয়া ফেলে । শালামাঙ্ক ও ঔস্তরলিজে ইহাই ঘটিয়াছিল। ঔরঙ্গজেবও এই স্বতঃসিদ্ধ রণতত্ত্ব জানিতেন । তিনি ইহাও জানিতেন যে, পাশ্বস্থিত শক্রর সঙ্গে যুদ্ধ করা যায় বটে, কিন্তু তাহা করিতে গেলে নিজ সৈন্তকে ফিরাইয়া শত্রুর সম্মুখবর্তী করিতে হয়। এই পাৰ্ব্বত্যপথে তাদৃশ মহতী
পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/৮১
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।