পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/২৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বঙ্কিম রচনাবলী সমােজভেদ, ভাষার ভেদ, আচার ব্যবহারের ভেদ, নানা ভেদ, শেষে জাতিভেদে পরিণত হইল। বাহিক হইতে পৌন্ড্র পৰ্যন্ত, কাশমীর হইতে চোলা ও পান্ড্য পৰ্যন্ত সমস্ত ভারত-ভুমি মক্ষিকাসমাকুল মধ্যচক্রের ন্যায় নানা জাতি, নানা সমাজে পরিপািণ হইল। পরিশেষে, কপিলাবন্ধুর রাজকুমার শাক্যসিংহের হস্তে এক অভিনব ধমের সন্টি হইলে, অন্যান্য প্রভেদের উপর ধৰ্ম্মভেদ জন্মিল। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন রাজ্য, ভিন্ন ধৰ্ম্মম; আর একজাতীয়ত্ব কোথায় থাকে ? সাগরমধ্যস্থ মীনদলবৎ ভারতবষীয়েরা একতাশন্য হইল। পরে আবার মসলমান আসিল। মসলমানদিগের বংশবদ্ধি হইতে লাগিল। কালে সাগরোম্পিমর উপর সাগরোশিমবং নাতন নািতন মসলমান সম্প্রদায়, পাশ্চাত্য পৰ্ব্ববতপার হইতে আসিতে লাগিল। দেশীয় লোকে সহস্ৰে সহস্রে রাজান,কম্পপার লোভে বা রাজপীড়নে মসলমান হইতে লাগিল। অতএব ভারতবষীবাসিগণ মাসলমান হিন্দ মিশ্রিত হইল। হিন্দ, মসলমান, মোগল, পাঠান, রাজপতি, মহারাষ্ট্ৰ, একত্র কম্পমা করিতে লাগিল। তখন জাতির ঐক্য কোথায় ? ঐক্যজ্ঞান কিসে থাকবে ? এই ভারতবর্ষে নানা জাতি। বাসস্থানের প্রভেদে, ভাষার প্রভেদে, বংশের প্রভেদে, ধমের প্রভেদে, নানা জাতি। বাঙ্গালি, পঞ্জাবী, তৈলঙ্গী, মহারাষ্ট্ৰী, রাজপতি, জাঠ, হিন্দ, মসলমান, ইহার মধ্যে কে কাহার সঙ্গে একতায্যক্ত হইবে ? ধৰ্ম্মমগত ঐক্য থাকিলে বংশগত ঐক্য নাই, বংশগত ঐক্য থাকিলে ভাষাগত ঐক্য নাই, ভাষাগত ঐক্য থাকিলে নিবাসগত ঐক্য নাহ। রাজপত জাঠ, এক ধৰ্ম্মমাবলম্পবী হইলে, ভিন্নবংশীয় বলিয়া ভিন্ন জাতি; বাঙ্গালি বেহারী একবংশীয় হইলে, ভাষাভেদে ভিন্ন জাতি; মৈথিলি কনেজী একভাষী হইলে, নিবাসভেদে ভিন্ন জাতি। কেবল ইহাই নহে। ভারতবর্ষের এমনই অদ্যান্ট, যেখানে কোন প্রদেশীয় লোক সব্বাংশে এক; যাহাঁদের এক ধৰ্ম্মম , এক ভাষা, এক জাতি, এক দেশ, তাহদের মধ্যেও জাতির একতাজ্ঞান নাই। বাঙ্গালির মধ্যে বাঙ্গালিজাতির একতা বোধ নাই, শীকের মধ্যে শীকজাতির একতা বোধ নাই। ইহারও বিশেষ কারণ আছে। বহকাল পয্যন্ত বহসংখ্যক ভিন্ন জাতি এক বহিৎ সাম্রাজ্যভুক্ত হইলে ক্ৰমে জাতিজ্ঞান লোপ হইতে থাকে। ভিন্ন ভিন্ন নদীর মাখনিগত জলরাশি যেমন সমন্দ্ৰে আসিয়া পড়িলে, আর তন্মধ্যে ভেদজ্ঞান করা যায় না, বহৎ সাম্রাজ্যভুক্ত ভিন্ন জাতিগণের সেইরাপ ঘটে। তাহাদিগের পার্থক্য যায়, অথচ ঐক্য জন্মে না। রোমক সাম্রাজ্যমধ্যগত জাতিদিগের এইরহপ দশা ঘটিয়াছিল। হিন্দীদিগেরও তােহাঁই ঘটিয়াছে। জাতিপ্রতিষ্ঠা নানা কারণে ভারতবর্ষে অনেক দিন হইতে লোপ হইয়াছে। লোপ হইয়াছে বলিয়া কখন হিন্দসমাজ কর্তৃক কোন জাতীয় কাৰ্য্য সমাধা হয় নাই। লোপ হইয়াছে বলিয়া, সকল জাতীয় রাজাই হিন্দরাজ্যে বিনা বিবাদে সমাজ কর্তৃক অভিষিক্ত হইয়াছেন। এই জন্যই স্বাতন্ত্র্যরক্ষার কারণ হিলদসমাজ কখন তডিজনীর বিক্ষেপও করে নাই। ইতিহাসকীৰ্ত্তিত কালমধ্যে কেবল দাইবার হিন্দসমাজমধ্যে জাতিপ্রতিষ্ঠার উদয় হইয়াছিল। একবার, মহারাষ্ট্রে শিবাজী এই মহামন্ত্র পাঠ করিয়াছিলেন। তাঁহার সিংহনাদে মহারাষ্ট্ৰ জাগরিত হইয়াছিল। তখন মহারাষ্ট্ৰীয়ে মহারাষ্ট্ৰীয়ে ভ্ৰাতৃভাব হইল। এই আশচষ্য মন্ত্রের বলে অজিতপািব্ব মোগল সামাজ্য মহারাষ্ট্ৰীয় কৰ্ত্তক বিনষ্ট হইল। চিরজয়ী মসলমান হিন্দ কর্তৃক বিজিত হইল। সমদায় ভারতবর্ষ মহারাস্ট্রের পদাবনত হইল। অদ্যপি মাহাট্টা, ইংরেজের সঙ্গে ভারতবষ ভাগে ভোগ করিতেছে। দ্বিতীয় বারের ঐন্দ্রজালিক রণজিৎ সিংহ; ইন্দ্ৰজাল খালসা। জাতীয় বন্ধন দঢ় হইলে পাঠানীদিগের স্বদেশেরও কিয়দংশ হিন্দর হস্তগত হইল। শতদুপারে সিংহনাদ শনিয়া, নিভীক ইংরেজও কম্পিত হইল! ভাগ্যক্রমে ঐন্দ্রজালিক মরিল। পাটতির ঐন্দ্রজালিক ভূর্বােহন্তে খালসা ইন্দ্রজািল ভাঙ্গিল। কিন্তু রামনগর এবং চিলিয়ানওয়ালা ইতিহাসে লেখা যদি কদাচিৎ কোন প্রদেশখন্ডে জাতিপ্রতিষ্ঠার উদয়ে এতদর ঘন্টিয়াছিল, তবে সমাদয় ভারত একজাতীয় বন্ধনে বদ্ধ হইলে কি না হইতে পারিত ? ইংরেজি ভারতবর্ষের পরমোপকারী। ইংরেজ আমাদিগকে নাতন কথা শিখাইতেছে। যাহা আমরা কখন জানিতাম না, তাহা জানাইতেছে; যাহা কখন দেখি নাই, শনি নাই, বঝি নাই, তাহা দেখাইতেছে, শনাইতেছে, বৰঝাইতেছে; যে পথে কখন চলি নাই, সে পথে কেমন করিয়া চলিতে হয়, তাহা দেখাইয়া দিতেছে। সেই সকল শিক্ষার মধ্যে অনেক শিক্ষা অমল্য। যে SO