পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৩৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিবিধ প্ৰবন্ধ-বঙ্গদেশের কৃষক যদি ঐ লোকাগমের সঙ্গে সঙ্গে আর কোটি মাদ্রা দেশের ধনবদ্ধি হইত, তাহা হইলে এ কম্পট হইত না। পশ্চাশ লক্ষ মাদ্রা বেতন ভাগের স্থানে কোটি মাদ্রা বেতন ভাগ হইত। তখন লোক বেশী আসাতেও সকলের দই টাকা করিয়া কুলাইত। অতএব দেখা যাইতেছে যে, লোকসংখ্যা বদ্ধি শ্রমোপজীবীদের মহৎ অনিমেটর কারণ। যে পরিমাণে লোকসংখ্যা বদ্ধি হয়, যদি সেই পরিমাণে দেশের ধনও বদ্ধি পায়, তবে শ্রমোপজীবীদের কোন অনিস্ট নাই। যদি লোকসংখ্যা বদ্ধির অপেক্ষাও ধনবদ্ধি গরতর হয়, তবে শ্রমোপজীবীদের শ্ৰীবদ্ধি-যথা, ইংলণ্ডড ও আমেরিকায়। আর যদি এই দইয়ের একও না ঘটিয়া, ধনবদ্ধির অপেক্ষা লোকসংখ্যাবদ্ধি অধিক হয়, তবে শ্রমোপজীবীদের দন্দশা। ভারতবর্ষে প্রথমোদ্যমেই তাঁহাই ঘটিল। লোকসংখ্যা বদ্ধি স্বাভাবিক নিয়ম। এক পরিষ ও এক সত্ৰী হইতে অনেক সন্তান জন্মে। তাহার একটি একটি সন্তানের আবার অনেক সন্তান জন্মে। অতএব মনষ্যের দন্দশা এক প্রকার সবভাবের নিয়মাদিন্ট। সকল সমাজেই এই অনিস্টপাতের সম্ভাবনা। কিন্তু ইহার সদ্যপায় আছে। প্রকৃত সদ্যপায় সঙ্গে সঙ্গে ধনবদ্ধি। পরন্তু যে পরিমাণে প্রজাবদ্ধি, সে পরিমাণে ধনবদ্ধি প্রায়ই ঘটিয়া উঠে না। ঘটিবার অনেক বিঘা আছে। অতএব উপায়ান্তর অবলম্বন করিতে হয়। উপায়ান্তর দাইটি মাত্র। এক উপায় দেশীয় লোকের কিয়দংশের দেশান্তরে গমন। কোন দেশে লোকের অন্নে কুলায় না, অন্য দেশে অন্ন খাইবার লোক নাই। প্রথমোক্ত দেশের লোক কতক শেষোক্ত দেশে যাউক,-তাহা হইলে প্রথমোক্ত দেশের লোকসংখ্যা কমিবে, এবং শেষোক্ত দেশের কোন অনিন্ট ঘটিবে না। এইরূপে ইংলন্ডের মহদীপকার হইয়াছে। ইংলন্ডের লোক আমেরিকা, অস্ত্রেলিয়া এবং পথিবীর অন্যান্য ভাগে বাস করিয়াছে। তাহাতে ইংলন্ডের শ্ৰীবদ্ধি হইয়াছে, উপনিবেশসকলেরও মঙ্গল হইয়াছে। দ্বিতীয় উপায়, বিবাহপ্রবত্তির দমন। এইটি প্রধান উপায়। যদি সকলেই বিবাহ করে, তবে প্রজাবিদ্ধির সীমা থাকে না। কিন্তু যদি কতক লোক অবিবাহিত থাকে, তবে প্রজাবদ্ধির লাঘব হয়। যে দেশে জীবনের সবচ্ছন্দ লোকের অভ্যস্ত, যেখানে জীবিকানিৰ্ব্ববাহের সামগ্রী প্রচুর পরিমাণে আবশ্যক, এবং কন্টে আহরণীয়, সেখানকার লোকে বিবাহপ্রবত্তি দমন করে। পরিবার প্রতিপালনের উপায় না দেখিলে বিবাহ করে না। ভারতবর্ষে এই দাইটির একটি উপায়ও অবলম্পিাবত হইতে পারে না। উষ্ণতা শরীরের শৈথিল্যজনক, পরিশ্রমে অপ্রবত্তিদায়ক। দেশান্তরে গমন উৎসাহ, উদ্যোগ, এবং পরিশ্রমের কাজ। বিশেষ, প্রকৃতিও তাহার প্রতিকলতাচরণ করিয়াছেন। ভারতবর্ষকে অলংঘ্য পৰ্ব্বত, এবং বাতাসঙ্কুল সমদ্রমধ্যস্থ করিয়া বন্ধ করিয়া রাখিয়াছেন। যবদ্বীপ, এবং বালি উপদ্বীপ ভিন্ন আর কোন হিন্দ উপনিবেশের কথা শানা যায় না। ভারতবর্ষের ন্যায় বহৎ এবং প্রাচীন দেশের এইরােপ সামান্য ঔপনিবেশিক ক্রিয়া গণনীয় নহে। বিবাহপ্রবত্তির দমন বিষয়ে ভারতবষের আরও মন্দাবস্থা। মাটি অচিড়াইলেই শস্য জন্মে, তাহার যৎকিঞ্চিৎ ভোজন করিলেই শরীরের উপকার হউক, না হউক, ক্ষধানিবত্তি এবং জীবনধারণ হয়। বায়ার উষ্ণতাপ্রযক্ত পরিচ্ছেদের বাহরূল্যের আবশ্যকতা নাই। সতরাং অপকৃষ্ট জীবিকা অতি সলভ। এমত অবস্থায় পরিবার প্রতিপালনে অক্ষমতাভয়ে কেহ ভীত নহে। সতরাং বিবাহপ্রবত্তিদমনে প্রজা পরাজমখ হইল। প্রজাবদ্ধির নিবারণে কোন উপায়ই অবলম্বিত না হওয়াতে তাহার বেগ অপ্রতিহত হইল। কাজে কাজেই সভ্যতার প্রথম আভু্যদয়ের পরেই ভারতীয় শ্রমোপজীবীর দম্পদশা আরম্ভ হইল। যে ভূমির উৰুর্বরতা ও বায়ার উষ্ণতাহেতুক সভ্যতার উদয়, তাহাতেই জনসাধারণের দরবস্থার কারণ সন্ট হইল। উভয়ই অলঙ্ঘ্য নৈসগিক নিয়মের ফল। শ্রমোপজীবীর এই কারণে দন্দশার আরম্ভ। কিন্তু একবার অবনতি আরম্ভ হইলেই, সেই অবনতিরই ফলে আরও অবনতি ঘটে। শ্ৰমোপজীবীদিগের যে পরিমাণে দরবস্থা বদ্ধি হইতে লাগিল, সেই পরিমাণে তাহাদিগের সহিত সমাজের অন্য সম্প্রদায়ের তারতম্য অধিকতর হইতে লাগিল। প্রথম, ধনের তারতম্য-তৎফলে অধিকারের তারতম্য। শ্রমোপজীবীরা হীন হইল বলিয়া তাহদের উপর বদ্ধপজীবীদিগের প্রভুত্ব বাড়িতে লাগিল। অধিক প্ৰভুদ্ধের ফল অধিক অত্যাচার। এই প্রভুত্বেই শব্দ্রপীড়ক সমিতিশাস্ত্রের মল। 9 OS