পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৪০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বঙ্কিম রচনাবলী সাধন করে, কিন্তু বাক্যবল বিনা রক্তপাতে, বিনা অস্ত্রাঘাতে, বাহবিলের কায্য সিদ্ধ করে। অতএব এই বাক্যবল কি, এবং তাহার প্রয়োগ লক্ষণ ও বিধােন কি প্রকার, তাহা বিশেষ প্রকারে সমালোচিত হওয়া কৰ্ত্তব্য। বিশেষতঃ এতদ্দেশ্যে। অসমদ্দেশে বাহবিল প্রয়োগের কোন সম্ভাবনা নাই-বত্তমান অবস্থায় অকৰ্ত্তব্যও বটে। সামাজিক অত্যাচার নিবারণের বাক্যবল একমাত্র উপায় । অতএব বাক্যবলের বিশেষ প্রকারে উন্নতির প্রয়োজন । বস্তুতঃ বাহবিল অপেক্ষা বাক্যবল সব্বাংশে শ্রেষ্ঠ। এ পৰ্যন্ত বাহবিলে পথিবীর কেবল অবনতিই সাধন করিয়াছে-যাহা কিছ উন্নতি ঘটিয়াছে, তাহা বাক্যবলে। সভ্যতার যাহা কিছ: যাহারই উন্নতি ঘটিয়াছে, তাহা বাক্যবলে। যিনি বক্তা, যিনি কবি, যিনি লেখক-দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, নীতিবেত্তা, ধৰ্ম্মমবেত্তা, ব্যবস্থাবেত্তা, সকলেই বাক্যবলেই বলী। ইহা কেহ মনে না করেন যে, কেবল বাহবিলের প্রয়োগ নিবারণই বাক্যবলের পরিণাম বা তদন্থেই বাক্যবল প্রযক্ত হয়। মনষ্যে কতক দরে পশচরিত্র পরিত্যাগ করিয়া উন্নতাবস্থায় দাঁড়াইয়াছে। অনেক সময়ে মনষ্যে ভয়ে ভীত না হইয়াও, সৎকম্পমানন্ঠানে প্রবত্ত। যদি সমগ্র সমাজের কখনও এক কালে কোনো বিশেষ সদনষ্ঠানে প্রবত্তি জন্মে, তবে সে সৎকাৰ্য্য অবশ্য অনতিিষ্ঠত হয়। এই সৎপথে জনসাধারণের প্রবত্তি কখনও কখনও জ্ঞানীর উপদেশ ব্যতীত ঘটে না। সাধারণ মনষ্যেগণ অজ্ঞ, চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ তাহাদিগকে শিক্ষা দেন। সেই শিক্ষাদায়িনী উপদেশমালা যদি যথাবিহিত বলশালিনী হয়, তবেই তাহা সমাজের হৃদয়ঙ্গমতা হয়। যাহা সমাজের একবার হৃদগত হয়, সমাজ আর তাহা ছাড়ে না-তদনন্ঠানে প্রবত্ত হয়। উপদেশবাক্যবলে আলোড়িত সমাজ বিপ্লত হইয়া উঠে। বাক্যবলে এইরপে যাদশ সামাজিক ইন্ট সাধিত হয়, বাহবিলে তাব্দশ কখনও ঘটিবার সম্ভাবনা নাই। মাসা, ইসা, শাক্যসিংহ প্রভৃতি বাহবিলে বলী নহেন—বাক্যবীর মাত্র। কিন্তু ইসা, শাক্যসিংহ প্রভৃতির দ্বারা পথিবীর যে ইস্ট সাধিত হইয়াছে, বাহাবলবীরগণ কর্তৃক তাহার শতাংশ নহে। বাহবিলে যে কখনও কোন সমাজের ইন্ট সাধন হয় না, এমত নহে। আত্মরক্ষার জন্য বাহবলই শ্রেষ্ঠ। আমেরিকায় প্রধান উন্নতিসাধনকৰ্ত্তা বাহাবলবীর ওয়াশিংটন। হলন্ড বেলজিয়মের প্রধান উন্নতিসাধনকৰ্ত্তা বাহাবলবীর অরেঞ্জের উইলিয়ম। ভারতবর্ষের আধনিক দগতির প্রধান কারণ-বাহবিলের অভাব। কিন্তু মোটের উপর দেখিতে গেলে, দেখা যাইবে যে, বাহাবল অপেক্ষা বাক্যবলেই জগতের ইন্ট সাধিত হইয়াছে। বাহবিল পশরে বল-বাক্যবল মনষ্যের বল। কিন্তু কতকগলা বকিতে পারিলে বাক্যবল হয় না।—বাক্যের বলকে আমি বাক্যবল বলিতেছি না। বাক্যে যাহা ব্যক্ত হয়, তাহারই বলকে বাক্যবল বলিতেছি। চিন্তাশীল চিন্তার দ্বারা জাগতিক তত্ত্বসকল মনোমধ্য হইতে উদ্ভূত করেন-বক্তা তাহা বাক্যে লোকের হৃদয়গত করান। এতদভয়ের বলের সমবায়কে বাক্যবল বলিতেছি। অনেক সময়েই এই বল একাধারে নিহিত-কখন কখন বলের আধার পথিক ভূত। একত্ৰিত হউক, পথক ভূত হউক, উভয়ের সমবায়ই বাক্যবল। (অসম্পণে) दाढ उ9ाबा* লিখিবার ভাষা প্রায় সকল দেশেই লিখিত ভাষা এবং কথিত ভাষায় অনেক প্রভেদ। যে সকল বাঙ্গালী ইংরেজী সাহিত্যে পারদশী, তাঁহারা একজন লন্ডনী কন্কনী বা একজন কৃষকের কথা সহজে বঝিতে পারেন না, এবং এতদ্দেশে অনেক দিন বাস করিয়া বাঙ্গালীর সহিত কথাবাত্তা কহিতে কহিতে যে ইংরেজেরা বাঙ্গালা শিখিয়াছেন, তাঁহারা প্রায় একখানিও বাঙ্গালাগ্রন্থ বঝিতে পারেন

  • বঙ্গদর্শন, ১২৮৫, জ্যৈষ্ঠ। ッ*