পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৪২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বঙ্কিম রচনাবলী গোমস্তার চোখ পড়িল। তিনি আট আনার স্ট্যাম্প খরচ করিয়া, উপযক্ত আদালতে “ক্রোক সহায়তার” প্রার্থনায় দরখাস্ত করিলেন। দরখাস্তের তাৎপৰ্য্য এই “পরাণ মডেলের নিকট খাজনা হাঙ্গামা খন জখম করিবে বলিয়া লোক জমােয়ত করিয়াছে। অতএব আদালত হইতে পিয়াদা মোকররা হউক।” গোমস্তা নিরীহ ভাল মানষ, কেবল পরাণ মন্ডলের যত অত্যাচার। সতরাং আদালত হইতে পিয়াদা নিযক্ত হইল। পিয়াদা ক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়াই মায়াময় রৌপ্যচক্রের পাঠাইয়া দিল। ইহার নাম “ক্রোক সহায়তা”। পরাণ দেখিল সব্বস্ব গেল। মহাজনের ঋণও পরিশোধ করিতে পারিব না, জমীদারের খাজানাও দিতে পারিব না, পেটেও খাইতে পাইব না। এত দিন পরাণ সহিয়াছিল-কুমীরের সঙ্গে বাদ করিয়া জলে বাস করা চলে না। পরাণ মন্ডল শানিল যে, ইহার জন্য নালিশ চলে। পরাণ নালিশ করিয়া দেখিবো। কিন্তু সে ত সোজা কথা নহে। আদালত এবং বারাঙ্গনার মন্দির তুল্য; অৰ্থ নাহিলে প্রবেশের উপায় নাই। চট্যাম্পের মাল্য চাই; উকীলের ফিস চাই; আসামী সাক্ষীর তলাবানা চাই; সাক্ষীর খোরাকি চাই; সাক্ষীদের পারিতোষিক আছে; হয়ত আমীন খরচা লাগিবে। এবং আদালতের পিয়াদা ও আমলাবগ কিছ কিছর প্রত্যাশা রাখেন। পরাণ নিঃসবে।--তথাপি হাল বলদ ঘটি বাটি বেচিয়া আদালতে নালিশ করিল। ইহার অপেক্ষা তাহার গলায় দাঁড়ি দিয়া মারা ভাল ছিল। অমনি জমীদারের পক্ষ হইতে পালটা নালিশ হইল যে, পরাণ মন্ডল ক্রোক অদল করিয়া সকল ধান কাটিয়া লইয়া বিক্রয় করিয়াছে। সাক্ষীরা সকল জমীদারের প্রজা-সতরাং জমীদারের বশীভূত; স্নেহে নহে—ভয়ে বশীভুত। সতরাং তাঁহার পক্ষেই সাক্ষ্য দিল। পিয়াদা মহাশয় রৌপ্যমন্ত্রের সেই পথাবত্তীর্ণ। সকলেই বলিল, পরাণ ক্ৰোক আদল করিয়া ধান কাটিয়া বেচিয়াছে। জমীদারের নালিশ ডিক্ৰী হইল, পরাণের নালিশ ডিসমিস হইল। ইহাতে পরাণের লাভ প্রথমতঃ, জমীদারকে ক্ষতিপরণ দিতে হইল, দ্বিতীয়তঃ, দই মোকদ্দমাতেই জমীদারের খরচা দিতে হইল, তৃতীয়তঃ, দই মোকদ্দমাতেই নিজের খরচা ঘর হইতে গেল। পরাণের আর এক পয়সা নাই, কোথা হইতে এত টাকা দিবে ? যদি জমি বেচিয়া দিতে পারিল, তবে দিল; নচেৎ জেলে গেল; অথবা দেশত্যাগ করিয়া পলায়ন করিল। আমরা এমত বলি না যে, এই অত্যাচারগালিন সকলই একজন প্রজার প্রতি এক বৎসর মধ্যে হইয়া থাকে বা সকল জমীদারই এরাপ করিয়া থাকেন। তাহা হইলে দেশ রক্ষা হইত না। পরাণ মন্ডল কলিপিত ব্যক্তি-একটি কলিপিত প্ৰজাকে উপলক্ষ্য করিয়া, প্রজার উপর সচরাচর উদ্দেশ্য। আজি একজনের উপর একরপ, কাল অন্য প্রজার উপর অন্যরােপ পীড়ন হইয়া থাকে । জমীদারদিগের সকল প্রকার দৌরাত্ম্যের কথা যে বলিয়া উঠিতে পারিয়াছি, এমন্ত নহে । জমীদারবিশেষে, প্রদেশবিশেষে, সময়বিশেষে যে কত রকমে টাকা আদায় করা হয়, তাহার তালিকা করিয়া সমাপ্ত করা যায় না। সব্বত্র এক নিয়ম নহে; এক স্থানে সকলের এক নিয়ম নহে ; অনেকের কোন নিয়মই নাই, যখন যাহা পারেন, আদায় করেন। এক্ষণে জমীদারদিগের পক্ষে কয়েকটি কথা বলিবার প্রয়োজন আছে। প্রথমতঃ, আমরা পকেবই বলিয়াছি যে, সকল জমীদার অত্যাচারী নহেন। দিন দিন অত্যাচারপরায়ণ জমীদারের সংখ্যা কমিতেছে। কলিকাতাস্থ সংশিক্ষিত ভূস্বামীদিগের কোন অত্যাচার নাই-যাহা আছে, তাহা তাঁহাদিগের অজ্ঞাতে এবং অভিমতবিরদ্ধে, নায়েব গোমস্তাগণের দ্বারায় হয়। মফঃস্বলেও অনেক সশিক্ষিত জমীদার আছেন, তাঁহাদিগেরও প্রায় ঐরােপ । বড় বড় জমীদারদিগের অত্যাচার তত অধিক নহে;-অনেক বড় বড় ঘরে অত্যাচার একেবারে নাই। সামান্য সামান্য ঘরেই অত্যাচার অধিক। যাঁহার জমীদারী হইতে লক্ষ টাকা আইসে দৰবলা হইবারই সম্ভাবনা, কিন্তু যাঁহার জমীদারী হইতে বার মাসে বার শত টাকা আসে না, অথচ জমীদারী চাল চলনে চলিতে হইবে, তাঁহার মারপিট করিয়া আর কিছ সংগ্ৰহ করিবার ইচ্ছা! ON R