পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৪৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কৃষ্ণচরিত্র রামায়ণ ভিন্ন আর কোন গ্ৰন্থই এই নাম প্রাপ্ত হয় নাই, তখন বিবেচনা করিতে যে, ইহার বিশেষ ঐতিহাসিকতা আছে বলিয়াই এরাপ হইয়াছে। হইবে সত্য বটে যে, মহাভারতে এমন বিস্তুর কথা আছে যে, তাহা স্পষ্টতঃ আলীক, অসম্ভব, অনৈতিহাসিক। সেই সকল কথাগালি অলীক ও অনৈতিহাসিক বলিয়া পরিত্যাগ করিতে পারি। কিন্তু যে অংশে এমন কিছই নাই যে, তাহা হইতে ঐ অংশ অলীক বা অনৈতিহাসিক বিবেচনা করা যায়, সে অংশগলি অনৈতিহাসিক বলিয়া কেন পরিত্যাগ করিব ? সকল জাতির মধ্যে, প্রাচীন ইতিহাসে এইরুপ ঐতিহাসিকে ও অনৈতিহাসিকে, সত্যে ও মিথ্যায়, মিশিয়া গিয়াছে। রোমক ইতিহাসবেত্তা লিবি প্রভৃতি, যবন ইতিহাসবেত্তা হেরোডোটস প্রভৃতি, মসলমান ইতিহাসবেত্তা ফেরেশতা প্রভৃতি এইরপ ঐতিহাসিক বক্তান্তের সঙ্গে অনৈসগিক এবং অনৈতিহাসিক বাত্তান্ত মিশাইয়াছেন। তাঁহাদিগের গ্রন্থ সকল ইতিহাস বলিয়া গহীত হইয়া থাকে-মহাভারতই অনৈতিহাসিক বলিয়া একেবারে পরিত্যক্ত হইবে কেন ? আমি জানি যে, আধনিক ইউরোপীয়েরা এই সকল ইতিহাসবেত্তাদিগকে (Livy, Herodotus প্রভৃতিকে) আদর করেন না। কিন্তু তাঁহারা এমন বলেন না যে, ইহাদের গ্রন্থ অনৈসগিক ব্যাপারে পরিপািণ, এই জন্যই ইহারা পরিত্যাজ্য। তাঁহারা বলেন যে, ইহারা যে সকল সময়ের ইতিহাস লিখিয়াছেন, সে সকল সময়ে ইহারা নিজেও বিত্তমান ছিলেন না, কোন সমসাময়িক লেখকেরও সাহায্য পান নাই; অতএব তাঁহাদের গ্রন্থের উপর, প্রকৃত ইতিহাস বলিয়া নিভাির করা যায় না। এ কথা যথাৰ্থ, কিন্তু লিবি বা হেরোডোটাস অপেক্ষা মহাভারতের সমসাময়িকতা সম্পবন্ধে দাবি দাওয়া কিছ বেশী, তাহা এই গ্রন্থে সময়ান্তরে প্রমাণীকৃত হইবে। এই পৰ্য্যন্ত এখন বলিতে ইচ্ছা করি যে, আধনিক ইউরোপীয় সমালোচকেরা যাহাঁই বলন, প্রাচীন রোমক বা গ্ৰীক লিপি বা হেরোডোটাসের গ্রন্থকে কখন অনৈতিহাসিক বলিতেন না। পক্ষান্তরে এমন দিনও উপস্থিত হইতে পারে যে Giffon বা Froude অসমসাময়িক বলিয়া পরিত্যক্ত হইবেন। আর আধনিক সমালোচকের দল যাই বলন, লিবি বা হেরোডোটসকে একেবারে পরিত্যাগ করিয়া রোম বা গ্রীসের কোন ইতিহাস আজিও লিখিত হয় না। পাঠক মনে রাখিবেন যে, অনৈসগিকতার বাহল্যঘটিত যে দোষ, তাহারই বিচার হইতেছে। আমরা এখানে সে গৌরবে বঞ্চিত নাহি। তাঁহারা স্থির করিয়াছেন যে, ভারতবর্ষের পকেবতন অবস্থা জানিবার জন্য দেশীয় গ্রন্থ সকল হইতে কোন সাহায্য পাওয়া যায় না, কেন না, সে সকল অতিশয় অবিশ্বাসযোগ্য, কিন্তু গ্ৰীক লেখক Megasthenes এবং Kitesias এ বিষয়ে অতিশয় বিশ্বাসযোগ্য—সে জন্য ইহারাই সে বিষয় ইউরোপীয় লেখকদিগের অবলম্বন। কিন্তু এই লেখকদিগের ক্ষদ্র গ্রন্থগলিতে যে রাশি রাশি অদ্ভুত, অলীক, অনৈসগিক উপন্যাস পাওয়া যায়, তাহা মহাভারতের লক্ষ শ্লোকের ভিতরও পাওয়া যায় না। এ গ্রন্থগলি বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস, আর মহাভারত অবিশ্বাসযোগ্য কাব্য! কি অপরাধে ? এখন ইহাও স্বীকার করা যাউক যে, ঐ সকল ভিন্নদেশীয় ইতিহাসগ্রন্থের অপেক্ষা মহাভারতে অনৈসগিক ঘটনার বাহাল্য অধিক। তাহাতেও, যেটকু নৈসগিক ও সম্ভব ব্যাপারের ইতিবত্ত সেটকু গ্রহণ করিবার কোন আপত্তি দেখা যায় না। মহাভারতে যে অন্য দেশের প্রাচীন ইতিহাসের অপেক্ষা কিছ বেশী কালপনিক ব্যাপারের বাহাল্য আছে, তাহার বিশেষ কারণও আছে। ইতিহাসগ্রন্থে দাই কারণে অনৈসগিক বা মিথ্যা ঘটনা সকল স্থান পায়। প্রথম, লেখক জনশ্রীতির উপর নিভাির করিয়া, সেই সকলকে সত্য বিবেচনা করিয়া তাহা গ্রন্থভুক্ত করেন। দ্বিতীয়, তাঁহার গ্রন্থ প্রচারের পর, পরবতী লেখকেরা আপনাদিগের রচনা পাকবািবত্তীর্ণ লেখকের রচনামধ্যে প্রক্ষিপ্ত করে। প্রথম কারণে সকল দেশের প্রাচীন ইতিহাস কালপনিক ব্যাপারের সংস্পশোঁ দ্যুষিত হইয়াছে’-মহাভারতেও সেইরাপ ঘটিয়া থাকিবে। কিন্তু দ্বিতীয় কারণটি অন্য দেশের ইতিহাসগ্রন্থে সেরােপ প্রবলতা প্রাপ্ত হয় নাই— মহাভারতকেই বিশেষ প্রকারে অধিকার করিয়াছে। তাহার তিনটি কারণ আছে । প্রথম কারণ এই যে, অন্যান্য দেশে যখন ঐ সকল প্রাচীন ঐতিহাসিক গ্রন্থ প্রণীত হয়, তখন প্রায়ই সে সকল দেশে গ্রন্থ সকল লিখিত করিবার প্রথা চলিয়াছে। গ্রন্থ লিখিত হইলে, তাহাতে পরবত্তীৰ্ণ লেখকেরা সর্বীয় রচনা প্রক্ষিপ্ত করিবার বড় সংবিধা পান না-লিখিত গ্রন্থে 8SS