পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৫৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কৃষ্ণচরিত্র এ কথার আমরা এক্ষণে কোন উত্তর দিব না। ভরসা করি, ক্রমশঃ উত্তর আপনিই পরিস্ফটি হইবে। তবে ইহা বক্তব্য যে, শিশপালবধ-পৰ্ব্বাধ্যায়। যদি মৌলিক মহাভারতের অংশ হয়, তবে এমন বিবেচনা করা যাইতে পারে যে, এই সময়েই কৃষ্ণ ঈশ্বরত্বে প্রতিস্ঠিত হইতেছিলেন। এবং এ বিষয়ে তাঁহার সর্বপক্ষ বিপক্ষ দই পক্ষ ছিল। তাঁহার পক্ষীয়দিগের প্রধান ভীস্ম, এবং এবং পান্ডবেরা। তাঁহার বিপক্ষদিগের এক জন নেতা শিশপাল। শিশপালবধ বাত্তান্তের স্থল মৰ্ম্ম এই যে, ভীস্মাদি সেই সভামধ্যে কৃষ্ণের প্রাধান্য স্থাপনের চেষ্টা পান। শিশপাল তাহার বিরোধী হন। তাহাতে তুমলে বিবাদের যোগাড় হইয়া উঠে। তখন কৃষ্ণ শিশাপািলকে নিহত করেন, তাহাতে সব গোল মিটিয়া যায়। যজ্ঞের বিঘা বিনষ্ট হইলে, যজ্ঞ নিৰিবাঘের নির্বাহ হয়। এ সকল কথার ভিতর যথার্থ ঐতিহাসিকতা কিছমাত্র আছে কি না, তাহার মীমাংসার পকেবা বঝিতে হয় যে, এই শিশপালবধ-পৰ্ব্বাধ্যায় মৌলিক কি না ? এ কথাটার উত্তর বড় সহজ নহে। শিশাপালিবধের সঙ্গে মহাভারতের স্থলে ঘটনাগলির কোন বিশেষ সম্পবিন্ধ আছে, এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু তা না থাকিলেই যে প্রক্ষিপ্ত বলিতে হইবে, এমন নহে। ইহা সত্য বটে যে, ইতিপকেব। অনেক স্থানে শিশপাল নামে প্রবল পরাক্রান্ত এক জন রাজার কথা দেখিতে পাই। পরভাগে দেখি, তিনি নাই। মধ্যেই তাঁহার মন্ত্যু হইয়াছিল। পাণ্ডব-সভায় কৃষ্ণের হস্তে তাঁহার মাতুত্যু হইয়াছিল, ইহার বিরোধী কোন কথা পাই না। অনানুক্ৰমণিকাধ্যায়ে এবং পািব্ব সংগ্ৰহাধ্যায়ে শিশপাল্যবধের কথা আছে। আর রচনাবলী দেখিলেও শিশপালবধপঞ্চবাধ্যায়কে মৌলিক মহাভারতের অংশ বলিয়াই বোধ হয় বটে। মৌলিক মহাভারতের আর কয়টি অংশের ন্যায়, নাটকাংশে ইহার বিশেষ উৎকৰ্ষ আছে। অতএব ইহাকে অমৌলিক বলিয়া একেবাবে পরিত্যাগ করতে পারিতেছি না। তা না পারি, কিন্তু ইহাও পল্ট বোধ হয় যে, যেমন জরাসন্ধবধ-পৰ্ব্ব বাধ্যায়ে দই হাতের কারিগরি দেখিয়াছি, ইহাতেও সেই রকম। বরং জরাসন্ধবধের অপেক্ষা সে বৈচিত্র্য শিশাপালিবন্ধে বেশী। অতএব আমি এই সিদ্ধান্ত করিতে বাধ্য যে, শিশপালবধ স্থলতঃ মৌলিক বটে, কিন্তু ইহাতে দ্বিতীয় স্তরের কবির বা অন্য পরবত্তী লেখকের অনেক হাত আছে। এক্ষণে শিশপালবধ বক্তান্ত সবিস্তারে বলিব। আজিকার দিনেও আমাদিগের দেশে একটি প্রথা প্রচলিত আছে যে, কোন সম্প্রান্ত ব্যক্তির বাড়ীতে সভা হইলে সভাস্থ সবাবপ্রধান ব্যক্তিকে স্ৰক চন্দন দেওয়া হইয়া থাকে। ইহাকে “মােলাচন্দন” বলে। ইহা এখন পাত্রের গণ দেখিয়া দেওয়া হয় না, বংশমর্য্যাদা দেখিয়া দেওয়া হয়। কুলীনের বাড়ীতে গোষ্ঠীপতিকেই মােলাচন্দন দেওয়া হয়। কেন না, কুলীনের কাছে গোল্ঠীপতি বংশই বড় মান্য। কৃষ্ণের সময়ে প্রথাটা একটি ভিন্ন প্রকার ছিল। সভাস্থ সব্বপ্রধান ব্যক্তিকে অঘ্য প্রদান করিতে হইত। বংশমষ্যাদা দেখিয়া দেওয়া হইত না, পাত্রের নিজের গণ দেখিয়া দেওয়া হইত। যধিস্ঠিরের সভায় অঘ্য দিতে হইবে-কে ইহার উপযক্ত পাত্রে ? ভারতবষীয় সমস্ত রাজগণ সভ্যস্থ হইয়াছেন, ইহার মধ্যে সৰবশ্রেষ্ঠ কে ? এই কথা বিচাৰ্য্য। ভীস্ম বলিলেন, “কৃষ্ণই সব্বশ্রেশঠ। ইহাকে অঘ্য প্ৰদান কর।” প্রথম যখন এই কথা বলেন, তখন ভীষ্মম যে কৃষ্ণকে দেবতা বিবেচনাতেই সব্বশ্রেষ্ঠ স্থির করিয়াছিলেন, এমন ভাব কিছই প্রকাশ নাই। কৃষ্ণ “তেজঃ বল ও পরাক্রম বিষয়ে শ্রেষ্ঠ” বলিয়াই তাঁহাকে অঘৰ্যদান করিতে বলিলেন। ক্ষত্ৰগণে কৃষ্ণ ক্ষত্ৰিয়গণের শ্রেণীঠ, এই জন্যই অঘ্য দিতে বলিলেন। এখানে দেখা যাইতেছে, ভীস্ম কৃষ্ণের মনষ্যচরিত্রই দেখিতেছেন । এই কথানসারে কৃষ্ণকে আঘ্য প্রদত্ত হইল। তিনিও তােহা গ্ৰহণ করিলেন । ইহা শিশাপালের অসহ্য হইল। শিশপাল ভীস্ম, কৃষ্ণ ও পান্ডবদিগকে এককালীন তিরস্কার করিয়া যে বক্তৃতা করিলেন, বিলাতে পালেমেণ্ট মহাসভায় উহা উক্ত হইলে উচিত দরে বিকাইত। তাঁহার বক্তৃতার প্রথম ভাগে তিনি যাহা বলিলেন, তাঁহার বামিতা বড় বিশদ্ধ অথচ তীৱ । কৃষ্ণ রাজা নহেন, তবে এত রাজা থাকিতে তিনি আঘ্য পান কেন ? যদি স্থবির বলিয়া তাঁহার পজা করিয়া থােক, তবে তাঁর বাপ বসদেবকে পজা করিলে না কেন ? তিনি তোমাদের আত্মীয় এবং প্ৰিয়চিকীষ বলিয়া কি তাঁর পিজা করিয়াছ ? শ্বশর দ্রুপদ থাকিতে তাঁকে কেন ? á象>