পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/২৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিষবক্ষ (t প্রথম পরিচ্ছেদ ঃ নগেন্দ্রের নৌকাযাত্রা নগেন্দ্র দত্ত নৌকারোহণে যাইতেছিলেন। জ্যৈষ্ঠ মাস, তুফানের সময় ; ভাৰ্য্যা সৰ্য্যেমখী মাথার দিব্য দিয়া বলিয়া দিয়াছিলেন, দেখিও নৌকা সাবধানে লইয়া যাইও, তুফান দেখিলে লাগাইও । ঝড়ের সময় কখন নৌকায় থাকিও না। নগেন্দ্র স্বীকৃত হইয়া নৌকারোহণ করিয়াছিলেন, নহিলে সৰ্য্যেমখী ছাড়িয়া দেন না। কলিকাতা না গেলেও নহে, অনেক কাজ ছিল। নগেন্দ্রনাথ মহাধনবান ব্যক্তি, জমিদার। তাঁহার বাসস্থান গোবিন্দপাের। যে জেলায় সেই গ্রাম, তাহার নাম গোপন রাখিয়া, হরিপর বলিয়া তাহার বর্ণনা করিব। নগেন্দ্র বাব, যােবা পরিষ, বয়ঃক্রম ত্রিংশৎ বর্ষ মাত্র। নগেন্দ্রনাথ আপনার বজরায় যাইতেছিলেন। প্রথম দই এক দিন নিবিবাঘের গেল। নগেন্দ্ৰ দেখিতে দেখিতে গেলেন, নদীব জল অবিরল চল চল চলিতেছে— ছটিতেছে—বাতাসে নাচিতেছে—-রৌদ্ৰে হাসিতেছে—আবত্তে ডাকিতেছে। জল অশ্রান্ত—অনন্ত— ক্ৰীড়াময়। জলের*ধারে তীরে তীরে মাঠে মাঠে রাখালেরা গোর, চরাইতেছে, কেহ বা বক্ষের তলায় বসিয়া গান করিতেছে, কেহ বা তামাকু খাইতেছে, কেহ বা মারামারি করিতেছে, কেহ। কেহ ভূজা খাইতেছে। কৃষকে লাঙ্গল চাষিতেছে, গোর, ঠেঙ্গাইতেছে, গোরকে মানষের অধিক করিয়া গালি দিতেছে, কৃষাণকেও কিছ কিছ ভাগ দিতেছে। ঘাটে ঘাটে কৃষকের মহিষীরাও কলসী, ছোড়া কাঁথা, পচা মাদর, রােপার তাবিজ, নাকছবি, পিতলের পৈাচে, দাই মাসের ময়লা পরিধেয় বস্ত্র, মসীনিন্দিত গায়ের বণ, রক্ষ কেশ লইয়া বিরাজ করিতেছেন। তাহার মধ্যে কোন সন্দরী মাথায় কাদা মাখিয়া মাথা ঘাঁসিতেছেন। কেহ ছেলে ঠেঙ্গাইতেছেন, কেহ কোন অনাদিন্দভটা, অব্যান্তনাম্নী প্রতিবাসিনীর সঙ্গে উদ্দেশে কোন্দল করিতেছেন, কেহ কাজেঠ কাপড় আছড়াইতেছেন। কোন কোন ভদ্রগ্রামের ঘাটে কুলকামিনীরা ঘাট আলো করিতেছেন। প্রাচীনারা বস্তৃতা করিতেছেন—মধ্যবয়স্কারা শিবপজা করিতেছেন—যাবতীরা ঘোমটা দিয়া ডুব দিতেছেন— আর বালক-বালিকারা চোচাইতেছে, কাদা মাখিতেছে, পাজার ফলে কুড়াইতেছে, সাঁতার দিতেছে, সকলের গায়ে জল দিতেছে, কখন কখন ধ্যানে মগ্না মাদ্রিতনয়না কোন গহিণীর সম্মমখস্থ কাদার শিব লইয়া পলাইতেছে। ব্রাহ্মণ ঠাকুরেরা নিরীহ ভালমানষের মত আপন মনে গঙগাস্তব পড়িতেছেন, পাজা করিতেছেন, এক একবার আকন্ঠনিমজিজতা কোন যাবতীর প্রতি অলক্ষ্যে চাহিয়া লইতেছেন। আকাশে শাদা মেঘ রৌদ্রতপত হইয়া স্থাটিতেছে, তাহার নীচে কৃষ্ণবিন্দবাৎ পাখী উড়িতেছে, নারিকেল গাছে চিল বসিয়া, রাজমন্ত্রীর মত চারি দিক দেখিতেছে, কাহার কিসে ছোঁ মারিবে। বক ছোট লোক, কাদা ঘাঁটিয়া বেড়াইতেছে। ডাহক রসিক লোক, ডুব মারিতেছে। আর আর পাখী হালকা লোক, কেবল উড়িয়া বেড়াইতেছে। হাটরিয়া নৌকা হাঁটর হটর করিয়া যাইতেছে—আপনার প্রয়োজনে }। খেয়া নৌকা গজেন্দ্রগমনে যাইতেছে—পরের প্রয়োজনে। বোঝাই নৌকা যাইতেছে না,--তাহদের প্রভুর প্রয়োজন মাত্র। নগেন্দ্র প্রথম দই এক দিন দেখিতে দেখিতে গেলেন। পরে এক দিন আকাশে মেঘ উঠিল, মেঘ আকাশ ঢাকিল, নদীর জল কালো হইল, গাছের মাথা কটা হইল, মেঘের কোলে বক উড়িল, নদী নিসপন্দ হইল। নগেন্দ্ৰ নাবিকদিগকে আজ্ঞা করিলেন, “নৌকাটা কিনারায় বাঁধিও।” রহমত মোল্লা মাঝি, তখন নেমাজ করিতেছিল, কথার উত্তর দিল না। রহমত আর কখন মাঝিগিরি করে নাই—তাহার নানার খালা মাঝির মেয়ে ছিল, তিনি সেই গব্বে মাঝিগিরির উমেদার হইয়াছিলেন, কপালক্ৰমে সিদ্ধ।কাম হইয়াছিলেন। রহমত হাঁকে ডাকে খাটো নন, নেমাজ সমাপত হইলে বাবর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “ভয় কি, হােজর! আপনি নিচিন্ত থাকুন।” রহমত মোল্লার এত সাহসের কারণ এই যে, কিনারা অতি নিকট, অবিলম্বোেবই কিনারায় নৌকা লাগিল । তখন নাবিকেরা নামিয়া নৌকা কাছি করিল। বোধ হয়, রহমত মোল্লার সঙ্গে দেবতার কিছ, বিবাদ ছিল, ঝড় কিছ, গারতের বেগে আসিল । ঝড় আগে আসিলা। ঝড় ক্ষণেক কাল গাছপালার সঙ্গে মল্লযদ্ধ করিয়া সহোদর বান্টিকে ডাকিয়া আনিল। তখন দাই ভাই বড় মাতামাতি আরম্ভ করিল। ভাই বন্টি, ভাই ঝড়ের কাঁধে চড়িয়া RVS