পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/২৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বণ্ডিকম রচনাবলী লাভের মধ্যে এই, হীরা আপন হাতে তামাকু সাজিয়া দেয়। হীরা, কালো-চুড়ি পরা হাতখানিতে হােকা ধরিয়া মালীর হাতে দেয়, মালী বাড়ী গিয়া রাত্রে তাই ভাবে। হীরার বাড়ী হীরার আয়ী থাকে, আর হীরা। এক ঘরে আয়ী, এক ঘরে হীরা শোয় । হীরা কুন্দকে আপনার কাছে বিছানা করিয়া রাত্রে শায়াইল। কুন্দ শইল—ঘমাইল না। পরদিন তাহাকে সেইখানে রাখিল। বলিল, “আজি কালি দই দিন থাক; দেখ, রাগ না পড়ে, পরে যেখানে ইচ্ছা, সেইখানে যাইও ।“ কুন্দ রহিল। কুন্দের ইচ্ছানসারে তাহাকে ল্যুকাইয়া রাখিল । ঘরে চাবি দিল, আয়ী না দেখে। পরে বাবার বাড়ীতে কাজে গেল। দই প্রহর বেলায় আয়ী যখন স্নানো যায়, হীরা তখন আসিয়া কুন্দকে স্নানাহার করাইল। আবার চাবি দিয়া চলিয়া গেল। রাত্রে আসিয়া চাবি খলিয়া উভয়ে শয্যা রচনা করিল। “টিট-কিটি-খিট-খিটি-খাট’ বাহির দয়ারের শিকল সাবধানে নড়িল। হীরা বিস্মিত হইল। একজনমাত্র কখনও কখনও রাত্রে শিকল নাড়ে। সে বাবার বাড়ীর দাবারবান, রাত ভিত ডাকিতে আসিয়া শিকল নাড়ে। কিন্তু তাহার হাতে শিকল অমন মধর বলে না, তাহার হাতে শিকল নাড়িলে, বলে ‘কট কট কটাঃ, তোর মাথা মন্ড উঠা ! কড় কড় কড়াং! খিল খোল, নয়। ভাণ্ডিগ ঠ্যাং।” তা ত শিকল বলিল না। এ শিকল বলিতেছে, “কিট কিট কিটি ! দেখি কেমন আমার হীরোটি ? খিট খাট ছান ! উঠলো আমার হীরামনী! ঠিটা ঠিটা ঠিঠি ঠিনিক— আয় রে আমার হীরা মাণিক।” হীরা উঠিয়া দেখিতে গেল ; বাহির দয়ার খালিয়া দেখিল, সত্ৰীলোক। প্রথমে চিনিতে পারিল না, পরেই চিনিল—“কে ও গঙ্গাজল ! এ কি ভাগ্য!” হীরার গঙ্গাজল মালতী গোয়ালিনী। মালতী গোয়ালিনীর বাড়ী দেবীপাের—দেবেন্দ্র বাবার বাড়ীর কাছে—বড় রসিকা সত্ৰীলোক। বয়স বৎসর ত্ৰিশ বত্ৰিশ, সাড়ী পরা, হাতে রলি, মাখে পানের রাগ। মালতী গোয়ালিনী প্রায় গৌরাঙ্গনী---একট, রৌদ্র পোড়া-—মখে রাঙ্গা রাঙগা দাগ, নাক খাঁদা-কপালে উল্লিক। কসে তামাকুপোড়া টেপা আছে। মালতী গোয়ালিনী দেবেন্দ্র বাবর দাসী নহে-আশ্রিতাও নহে—অথচ তাঁহার বড় অনাগত—অনেক ফরমায়েস-যাহা অন্যের অসাধ্য, তাহা মালতী সিদ্ধ করে। মালতীকে দেখিয়া চতুরা হীরা বলিল, “ভাই গঙ্গাজল ! অন্তিম কালে যেন তোমায় পাই! কিন্তু এখন কেন ?” গঙ্গাজল চুপি চুপি বলিল, “তোকে দেবেন্দ্ৰ বােব ডেকেছে।” হীরা কাদা মাখে, হাসিয়া বলিল, “তুই কিছল পাবি নাকি ?” মালতী দাই আঙ্গলের দ্বারা হীরাকে মারিল, “১ারণ আর কি! তোর মনের কথা তুই জানিস! এখন চা।” হীরা ইহাই চায়। কুন্দকে বলিল, “আমার বাবরে বাড়ী যেতে হলো—ডাকিতে এসেছে ; কে জানে কেন ?” বলিয়া প্ৰদীপ নিবাইল এবং অন্ধকারে কৌশলে বেশভূষা করিয়া মালতীর সঙ্গে যাত্ৰা করিল। দই জনে অন্ধকারে গলা মিলাইয়া—— “মানের মতন রতন পেলে যতন করি তায় সাগর ছোচে তুলবো নােগর পতন করে কায়।” ইতি গীত গায়িতে গায়িতে চলিল । দেবেন্দ্রের বৈঠকখানায় হীরা একা গেল। দেবেন্দ্র দেবীর আরাধনা করিতেছিলেন, কিন্তু আজি সর, কাটিতেছিলেন। জ্ঞান টনটনে। হীবার সঙ্গে আজ অন্য প্রকার সম্ভাষণ করিলেন। স্তবস্তুতি কিছই না। বলিলেন, ‘হীরে, সে দিন আমি অধিক মদ খাইয়া তোমার কথাব মৰ্ম্ম কিছই গ্রহণ করিতে পারি নাই। কেন আসিয়াছিলে ? সেই কথা জিজ্ঞাসা করিবার জন্য ডাকিয়া পঠাইয়াছি।” হনী । কেবল আপনাকে দশন করিতে আসিয়াছিলাম। দেবেন্দ্ৰ হাসিলেন। বলিলেন, “তুমি বড় বদ্ধিমতী ৷ ভাগ্যক্ৰমে নগেন্দ্র বাবা তোমার মত দাসী পেয়েছেন। বঝিলাম তুমি হরিদাসী বৈষ্ণবীর তত্ত্বে এসেছিলো। আমার মনের কথা জানিতে এসেছিলো। কেন আমি বৈষ্ণবী সাজি, কেন দত্তবাড়ী যাই, এই কথা জানিতে আসিয়াছিলে। তাহা একপ্রকার জানিয়াও গিয়ােছ। আমিও তোমার কাছে সে কথা লকাইব না। তুমি প্রভুর কাজ করিয়া প্রভুর কাছে পরিস্কার পাইয়াছ, সন্দেহ নাই। এখন আমার একটি কাজ কর, আমিও পরিস্কার করিব।” રે છે 8