পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৩০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিষবক্ষ করিতে সেই বেহালা আনিয়া তাহাতে ছড়ি দিলেন। বেহালা ঘাঁকির ঘোঁকির করিতে লাগিল । দেবেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ বেহালা কোথায় পাইলে ?” হীরা কহিল, “একজন ভিখারীর কাছে কিনিয়াছিলাম।” দেবেন্দ্ৰ বেহালা হসোত লইয়া একপ্রকার চলনসই করিয়া লইলেন এবং তাহার সহিত কণঠ মিলাইয়া, মধরে সবরে ভাবযক্তি মধর পদ মধরভাবে গায়িলেন। হীরার চক্ষ আরও জীবলিতে লাগিল। ক্ষণকালজন্য হীরার সম্পপণ্য আত্মবিসমিতি জন্মিল। সে যে হীরা, এই যে দেবেন্দ্র, তাহা ভুলিয়া গেল। মনে করিতেছিল, ইনি স্বামী-আমি পত্নী। মনে করিতেছিল, বিধাতা দাই জনকে পরস্পরের জন্য সজন করিয়া, বহকাল হইতে মিলিত করিয়াছেন, বহকাল হইতে যেন উভয়ের প্রণয়সমুখে উভয়ে সখী। এই মোহে অভিভূত হীরার মনের কথা ম্যুখে ব্যক্ত হইল। দেবেন্দ্র হীরার মখে আদর্ধ ব্যক্তিস্বরে শনিলেন যে, হীরা দেবেন্দ্রকে মনে মনে প্ৰাণ সমপণ করিয়াছে। কথা ব্যক্ত হইবার পর হীরার চৈতন্য হইল, মস্তক ঘরিয়া উঠিল। তখন সে উন্মত্তের ন্যায় আকুল হইয়া দেবেন্দ্রকে কহিল, “আপনি শীঘ্র আমার ঘর হইতে যান।” দেবেন্দ্র বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “সে কি, হীরা ?” হীরা। আপনি শীঘ্ৰ যান—নহিলে আমি চলিলাম। দে। সে কি তাড়াইয়া দিতেছ। কেন ? হীরা। আপনি যান।--নাহিলে আমি লোক ডাকিব।--আপনি কেন আমার সববনাশ করিতে আসিয়াছিলেন ? হীরা তখন উন্মদিনীর ন্যায় বিবাশা। দে। একেই বলে সত্ৰীচরিত্র ! হীরা রাগিল——বলিল, “স্ত্রীচরিত্র ? সত্ৰীচরিত্র মন্দ নহে। তোমাদিগের ন্যায় পরিষের চরিত্রই অতি মন্দ। তোমাদের ধৰ্ম্মম জ্ঞান নাই—পরের ভাল মন্দ বোধ নাই—কেবল আপনার সখ খাজিয়া বেড়াও—কেবল কিসে কোন সত্ৰীলোকের সববনাশ করিবে, সেই চেন্টায় ফের। নাহিলে কেন তুমি আমার বাড়ীতে বসিলে ? আমার সববনাশ করিবে, তোমার কি এ অভিপ্রায় ছিল না ? তুমি আমাকে কুলটা ভাবিয়াছিলে, নহিলে কোন সাহসে বসিবে ? কিন্তু আমি কুলটা নাহি। আমরা দঃখী লোক, গতরা খাটাইয়া খাই—কুলটা হইবার আমাদের অবকাশ নাই--বড়মানষের বউ হইলে কি হাইতাম, বলিতে পারি না।” দেবেন্দ্ৰ ভ্ৰভঙ্গি করিলেন। দেখিয়া হীরা প্ৰীতা হইল। পরে উন্নমিতাননে দেবেন্দ্রের প্রতি সিথরদস্টি করিয়া কোমলতর সবরে কহিতে লাগিল, “প্ৰভু, আমি আপনার রােপগণ দেখিয়া পাগল হইয়াছি। কিন্তু আমাকে কুলটা বিবেচনা করিবেন। না। আমি আপনাকে দেখিলেই সখী হই। এজন্য আপনি আমার ঘরে বসিতে চাহিলে বারণ করিতে পারি নাই।--কিন্তু অবলা সত্ৰীজাতি—আমি বারণ করিতে পারি নাই বলিয়া কি আপনার বসা উচিত হইয়াছে ? আপনি মহাপাপিষ্ঠ, এই ছলে ঘরে প্রবেশ করিয়া আমার সব্বনাশ করিতে চেস্টা করিয়াছেন। এখনি আপনি এখান হইতে যান ।” দেবেন্দ্র আর এক ঢোক পান করিষা বলিলেন, “ভাল, ভাল! হীরে, তুমি ভাল বস্তৃতা করিয়াছ । আমাদের ব্রাহ্মসমাজে এক দিন বস্তৃতা দিবে ?” হীরা এই উপহাসে মম পীড়িত হইয়া, রোষকাতরস্বরে কহিল, “আমি আপনার উপহাসের যোগ্য নাই—আপনাকে অতি অধম লোকে ভালবাসিলেও, তাহার ভালবাসা লইয়া তামাসা করা ভাল নয়। আমি ধাৰ্ম্মিমক নহি, ধৰ্ম্মম বঝি না।—ধ্যমে আমার মন নাই। তবে যে আমি কুলটা নই বলিয়া সাপদ্ধা করিলাম, তাহার কারণ এই, আমার মনে মনে প্রতিজ্ঞা আছে, আপনার ভালবাসার লোভে পড়িয়া কলঙক কিনিব না। যদি আপনি আমাকে একটকুও ভালবাসিতেন, তাহা হইলে আমি এ প্রতিজ্ঞা করিতাম না—আমার ধৰ্ম্মম জ্ঞান নাই, ধৰ্ম্মেম ভক্তি নাই—আমি আপনার ভালবাসার তুলনায় কলঙ্ককে তৃণজ্ঞান করি। কিন্তু আপনি ভালবাসেন না—সেখানে কি সখের জন্য কলঙক কিনিব ? কিসের লোভে আমার গৌরব ছাড়িব ? আপনি যাবতী স্ত্রী হাতে পাইলে কখন ছাড়েন না, এজন্য আমার পজা গ্রহণ করিলেও করিতে পারেন, কিন্তু কালে আমাকে হয়ত ভুলিয়া যাইবেন, নয়ত যদি মনে রাখেন, তবে আমার কথা লইয়া দলবলের কাছে উপহাস করিবেন—এমন সথানে কেন আমি আপনার বাঁদনী হইব ? কিন্তু যে দিন। আপনি আমাকে ভালবাসিবেন, সেই দিন। আপনার দাসী হইয়া চরণসেবা করিব।” (9 O O