পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৩২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বঙ্কিম রচনাবলী গ্রামের মন্ডল মাতব্বরলোক আমনি কমিটিতে বসিয়া গেল। পালকীর ভিতর হইতে একটা বটওয়ালা পা বাহির হইয়াছিল। সকলেই সিদ্ধান্ত করিল, সাহেব আসিয়াছে—ছেলেরা ধ্রুব জানিত, বৌ আসিয়াছে। পালাকীর ভিতর হইতে নগেন্দ্রনাথ বাহির হইলেন। আমনি তাঁহাকে পাঁচ সাত জনে সেলাম করিল--কেন না, তাঁহার পেণ্টলন পরা, টপি মাথায় ছিল! কেহ ভাবিল, দারোগা ; কেহ ভাবিল, বরকন্দাজ সাহেব আসিয়াছেন। দশকদিগের মধ্যে প্রাচীন এক ব্যক্তিকে সম্বোধন করিয়া নগেন্দ্র শিবপ্রসাদ ব্ৰহ্মচারীর সংবাদ জিজ্ঞাসা করিলেন। জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি নিশ্চিত জানিত, এখনই কোন খনি মামলার সািরতহাল হইবে—অতএব সত্য উত্তর দেওয়া ভাল নয়। সে বলিল, “আজ্ঞে, আমি মশাই ছেলে মানষে, আমি অত জানি না।” নগেন্দ্ৰ দেখিলেন, একজন ভদ্রলোকের সাক্ষাৎ না পাইলে কায্যসিদিধ হইবে না। গ্রামে অনেক ভদ্রলোকের বসতিও ছিল। নগেন্দ্রনাথ তখন একজন বিশিস্টলোকের বাড়ীতে গেলেন। সে গাহের স্বামী রামকৃষ্ণ রায় কবিরাজ। রামকৃষ্ণ রায়, একজন বাব আসিয়াছেন দেখিয়া, যত্ন করিয়া একখানি চেয়ারের উপর নগেন্দ্রকে বসাইলেন। নগেন্দ্র বহ্মচারীর সংবাদ তাঁহার নিকট জিজ্ঞাসা করিলেন। রামকৃষ্ণ রায় বলিলেন, “ব্রহ্মচারী ঠাকুর এখানে নাই।” নগেন্দ্র বড় বিষগ্ন হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “তিনি কোথায় গিয়াছেন ?” উত্তর। তাহা বলিয়া যান নাই। কোথায় গিযোছেন, তাহা আমরা জানি না। বিশেষ তিনি এক সন্থানে সথায়ী নহেন : সৰ্ব্ববােদা নানা সন্থানে পয্যটন করিয়া বেড়ান। নগেন্দ্র। কবে আসিবেন, তাহা কেহ জানে ? রামকৃষ্ণ । তাঁহার কাছে আমার নিজেরও কিছ আবশ্যক আছে। এজন্য আমি সে কথারও তদন্ত করিয়াছিলাম। কিন্তু তিনি যে কবে আসিবেন তাহা কেহ বলিতে পারে না। নগেন্দ্র বড় বিষগ্ন হইলেন। পানশাচ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কত দিন। এখান হইতে গিয়াছেন ?” রামকৃষ্ণ । তিনি শ্রাবণ মাসে এখানে আসিয়াছিলেন। ভাদ্র মাসে গিয়াছেন। নগেন্দ্র। ভাল, এ গ্রামে হরমণি বৈষ্ণবীর বাড়ী কোথায় আমাকে কেহ দেখাইয়া দিতে পারেন ? রামকৃষ্ণ । হরমণির ঘর পথের ধারেই ছিল। কিন্তু এখন আর সে ঘর নাই। সে ঘর আগনি লাগিয়া পড়িয়া গিয়াছে। নগেন্দ্র আপনার কপাল টিপিয়া ধরিলেন। ক্ষীণতর সবরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হরমণি কোথায় আছে ?” রামকৃষ্ণ । তাহাও কেহ বলিতে পারে না। যে রাত্রে তাহার ঘরে আগমন লাগে, সেই অবধি সে কোথাও পলাইয়া গিয়াছে। কেহ কেহ এমনও বলে যে, সে আপনার ঘরে আপনি আগন দিয়া পলাইয়াছে। নগেন্দ্ৰ ভগনস্বর হইয়া কহিলেন, “তাহার ঘরে কোন সত্ৰীলোক থাকিত ?” রামকৃষ্ণ রায় কহিলেন, “না; কেবল শ্রাবণ মাস হইতে একটি বিদেশী সত্ৰীলোক পীড়িতা হইয়া আসিয়া তাহার বাড়ীতে ছিল। সেটিকে ব্রহ্মচারী কোথা হইতে আনিয়া তাহার বাড়ীতে রাখিয়াছিলেন। শনিয়াছিলাম, তাহার নাম সােয্যমখী। সত্ৰীলোকটি কাসরোগগ্ৰস্ত ছিল— আমিই তাহার চিকিৎসা করি। প্রায় আরোগ্য করিয়া তুলিয়াছিলাম—এমন সময়ে—” নগেন্দ্ৰ হাঁপাইতে হাঁপাইতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এমন সময়ে কি— ?” রামকৃষ্ণ বলিলেন, “এমন সময়ে হরবৈষ্ণবীর গহিদাহে। ঐ সত্ৰীলোকটি পড়িয়া মরিল!” নগেন্দ্র চৌকি হইতে পড়িয়া গেলেন। মাস্তকে দারণ আঘাত পাইলেন। সেই আঘাতে মচ্ছিত হইলেন। কবিরাজ তাঁহার শাশ্রষায় নিযক্ত হইলেন। বাঁচতে কে চাহে ? এ সংসার বিষময়। বিষবক্ষ সকলেরই গহপ্রাঙ্গণে। কে ভালবাসিতে চাহে ? অলটত্রিংশতত্তম পরিচ্ছেদ ঃ এত দিনে সব ফরাইল! এত দিনে সব ফরাইল। সন্ধ্যাকালে যখন নগেন্দ্র দত্ত মধ্যপাের হইতে পালকীতে উঠিলেন, তখন এই কথা মনে মনে বলিলেন, “আমার এত দিনে সব ফরাইল।” O RNR