পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উপন্যাস-প্রসঙ্গ দগেশনন্দিনী বঙিকমচন্দ্রের প্রথম বাংলা উপন্যাস-দগেশনন্দিনী ১৮৬৫ সনের মাচ্চ মাসে প্রকাশিত হয়। এ পস্তক-রচনা ১৮৬২ সনে বণ্ডিকমের চব্বিশ বৎসর বয়সে আরম্প্ৰভ হইয়া। ১৮৬৪ সনে শেষ হয়, মোটামটি এইরহপ বলা যায়। তিনি এখানি তাঁহার জ্যেষ্ঠাগ্রজ শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়কে উৎসগ করেন। ‘দগেশনন্দিনীর উৎপত্তি কি ঘটনা হইতে, তাহার বিবরণ। বঙ্কিমের কনিষ্ঠ সহোদর পণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এইরপ দিয়াছেন : “আমাদের খািল্লপিতামহ এক শত আট বৎসর বয়ঃক্ৰম পৰ্য্যন্ত জীবিত ছিলেন।...তাঁহার নিকট বঙ্কিমচন্দ্র ও আমরা সকলে গলপ শানিতাম। যাহা শনিতাম তাহা বঙগালার ইতিহাসের অন্তগত; উহা প্রায়ই বঙ্গের মসলমান রাজত্বের অবসানকালের কথা।...তাঁহার নিকট বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম গড়মান্দারণের ঘটনা শনিয়াছিলেন; যদিও ঐ ঘটনা আকবর শাহা বাদশাহের সময় ঘটিয়াছিল, তথাচ তিনি উহা জানিতেন। সেকালের প্রাচীনেরা মসলমান বাদশাহ দিগের সময়ের অনেক ঘটনা জানিতেন। আমাদের মেজঠাকুরদাদার মধ্যে মধ্যে বিষ্ণপর অঞ্চলে যাতায়াত ছিল। মান্দারণ গ্রাম জাহানাবাদ ও বিষ্ণপরের মধ্যস্থিত। ঐ অঞ্চলে মান্দারণের ঘটনাটি উপন্যাসের ন্যায় লোকমখে কিম্বদন্তী রাপে চলিয়া আসিতেছিল। মেজঠাকুরদা উহা ঐ স্থানে শনিয়াছিলেন, এবং মান্দারণের জমিদারের গড় ও বহৎ পরী ভগনাবস্থায় দেখিয়াছিলেন। তাঁহারই মাখে প্রথম শনি যে, উড়িষ্যা হইতে পাঠানেরা মান্দারণ গ্রামের জমিদারের পরেী লটপাট করিয়া তাঁহাকে ও তাঁহার স্ত্রী ও কন্যাকে বন্দী করিয়া লইয়া যায়, রাজপতিকুলতিলক কুমার জগৎসিংহ তাঁহাদের সাহায্যাৰ্থ প্রেরিত হইয়া বন্দী হইয়াছিলেন। এই গলপটি বঙিকমচন্দ্র আঠার উনিশ বর্ষ বয়ঃক্ৰমে শনিয়াছিলেন। তাহার কয়েক বৎসর পরে ‘দগেশনন্দিনী’ রচিত হইল।” (বঙ্কিম-প্রসঙ্গ, পঃ ৪৯-৫০) ‘দগেশনন্দিনী’ বাংলা সাহিত্যে ভাষা ও ভাবের নবযাগ প্রবত্তন করিয়াছিল। কিন্তু প্রকাশের পরিষেবা এখানির উৎকষাপকষ সম্পবন্ধে বণ্ডিকমচন্দ্র নিজে তেমন সিথর নিশ্চয় হইতে পারেন নাই। বঙ্কিমচন্দ্রের সাধারণতঃ এই রীতি ছিল যে, তাঁহার কোনও পােস্তক প্রকাশিত হইবার পকেবা কাহাকেও পড়িয়া শনাইতেন না, অথবা সহোদর ভিন্ন কাহাকেও পান্ডুলিপি সপশ করিতে পৰ্য্যন্ত দিতেন না। কিন্তু এই প্রথম উপন্যাসখানি সম্বন্ধে তাঁহার এ রীতির ব্যতিক্রম দেখিতে পাই। “দগেশনন্দিনী’ প্রকাশিত হইবার পকেবা কাঁটালপাড়ার বাটীতে অনেককে ইহা পড়িয়া শনাইয়াছিলেন। কনিষ্ঠ সহোদর পণচন্দ্র বলেন, “বোধ হয়, তাঁহার নিজের লেখনী-শক্তির প্রতি তখন তােদশ বিশ্ববাস জন্মে নাই, সেজন্য অন্যের মতামত জানিবার আকাঙক্ষা হইয়াছিল।” “দগেশনন্দিনী’ প্রকাশের পকেবা অভ্যাগতদের সমক্ষে বঙ্কিমচন্দ্র এখানি আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়াছিলেন। ঐ সম্পবন্ধে পাণচন্দ্ৰ লিখিয়াছেন : “এক সময়ে, বড়দিনের কি মহরমের ছটীতে আমার মনে নাই, অনেক ভদ্রলোক আসয়াছিলেন। তন্মধ্যে শিক্ষিত, অশিক্ষিত উভয় সম্প্রদায়ের লোকই ছিল। ভাটপাড়ার পন্ডিতগণও ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার হস্তলিখিত ‘দগেশনন্দিনী’ তাঁহাদের নিকট পাঠ করিতে আরম্ভ করিলেন। সকলে নিঃশবেদ বসিয়া শনিতে লাগিলেন; কেহ ঐ ঘরে প্রবেশ করিলে শ্রোতৃগণ বিরক্ত হইয়া উঠিতেছিলেন।...শ্রোতাদিগের মধ্যে কেহ কেহ অহিফেনভোগী ছিলেন; মহামহঃ তাহদের তামাক আবশ্যক হইত; তাঁহারা তামাক ডাকিতে ভুলিয়া গেলেন।...একজন প্রাচীন ভদ্রলোক মধ্যে মধ্যে চীৎকার করিয়া বলিতেছেন, আ মরি, আ মরি! কি বস্তৃতাই করিতেছেন।” এইরপে দাই দিনে গলপ পাঠ শেষ হইল। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম হইতে ধারণা ছিল ষে, “দগেশনন্দিনী’র ভাষা ব্যাকরণ-দোষে দাষিত। সেজন্য তিনি গলপ পাঠ শেষ হইলে উপস্থিত সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভাষার ব্যাকরণ-দোষ আছে—উহা কি লক্ষ্য করিয়াছেন ?? * মধ্য সদন সমিতিরত্ন বলিলেন, “গলপ ও ভাষার মোহিনী শক্তিতে আমরা এতই আকৃন্ট হইয়াছিলাম যে, আমাদের সাধ্য কি যে অন্যদিকে মন নিবিভ্ৰাট করি!” বিখ্যাত পন্ডিত * চন্দ্রনাথ বিদ্যারত্ন বলিলেন যে, “আমি স্থানে স্থানে ব্যাকরণ দোষ লক্ষ্য করিয়াছি বটে, কিন্তু সেই সেই স্থানে ভাষা আরও মধর হইয়াছে।” (ঐ, পঃ ৭ o-১) পণচন্দ্র আরও বলেন যে, “দগেশনন্দিনীর পান্ডুলিপি ভূদেব মখোপাধ্যায়ের জামাতা সাবিজ্ঞ তারাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এবং বিখ্যাত সমালোচক ক্ষেত্ৰনাথ ভট্টাচাৰ্য্যকে পাঠ করিতে দিয়াছিলেন। দ্রুক্ষত্রেনাথ এই উপন্যাসখানির মধ্যে ভাবী সাহিত্য-সমাটের সন্ধান পান এবং ভবিষ্যদবাণী করেন যে, বঙ্কিম ভবিষ্যতে উৎকৃষ্টতর উপন্যাস লিখিতে সক্ষম হইবেন। ՀԵ