পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৫০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রজনী অতএব বিনা সহায়ে বাড়ী ফিরিয়া যাইতে পারিলাম না-বাড়ী ফিরিয়া গেলেও সেই পাপ বিবাহ! অগত্যা হীরালালের সঙ্গে যাইতে হইল। তখন মনে হইল—আর কেহ অন্ধের সহায় থাক না থাক—মাথার উপর দেবতা আছেন; তাঁহারা কখনও লবঙ্গলতার ন্যায় পীড়িতকে পীড়ন করিবেন না; তাঁহাদের দয়া আছে, শক্তি আছে, অবশ্য দয়া করিয়া আমাকে রক্ষা করিবেন— নহিলে দয়া কার জন্য ? তখন জানিতাম না যে, ঐশিক নিয়ম বিচিত্র—মনষ্যের বন্ধির অতীত—আমরা যাহাকে দয়া বলি, ঈশ্ববরের অনন্ত জ্ঞানের কাছে তাহা দয়া নহে——আমরা যাহাকে পীড়ন বলি—ঈশবিরের অনন্ত জ্ঞানের কাছে তাহা পীড়ন নহে। তখন জানিতাম না যে, এই সংসারের অনন্ত চক্ৰ দয়াদাক্ষিণ্যাশন্য, সে চক্ৰ নিয়মিত পথে অনতিক্ষন্ন রেখায় অহরহ চলিতেছে, তাহার দারণ বেগের পথে যে পড়িবে—অন্ধ হউক, খঞ্জ হউক, আত্ত হউক, সেই পিষিয়া মরিবে। আমি অন্ধ নিঃসহায় বলিয়া, অনন্ত সংসারচক্ৰ পথ ছাড়িয়া চলিবে কেন ? হীরালালের সঙ্গে প্রশস্ত রাজপথে বাহির হইলাম--তাহার পদশবদ অনসরণ করিয়া চলিলাম—কোথাকার ঘড়িতে একটা বাজিল। পথে কেহ নাই—কোথাও শব্দ নাই—ব্দই একখানা গাড়ির শব্দ—দই একজন সারাপহৃতবদ্ধি কামিনীর অসম্পবদ্ধ গীতিশব্দ। আমি হীরালালকে সহসা জিজ্ঞাসা করিলাম? —“হীরালাল বাব, আপনার গায়ে জোর কেমন ?” হীরালাল একটা বিস্মিত হইল—বলিল, “কেন ?” আমি বলিলাম, ‘জিজ্ঞাসা করি।” হীরালাল বলিল, “তা মন্দ নয়।” আমি । তোমার হাতে কিসের লাঠি ? হীবা। তালের । আমি । ভাঙিগতে পাের ? হীরা। সাধ্য কি ? আমি। আমার হাতে দাও দেখি । হীরালাল আমার হাতে লাঠি দিল। আমি তাহা ভাঙ্গিয়া দিবখণ্ড করিলাম। হীরালাল আমার বল দেখিয়া বিসিন্মত হইল। আমি আধখানা তাহাকে দিয়া, আধখানা। আপনি রাখিলাম। তাহার লাঠি ভাঙ্গিয়া দিলাম দেখিয়া, হীরালাল রাগ করিল। আমি বলিলাম—“আমি এখন নিশিচন্ত হইলাম—রাগ করিও না। তুমি আমার বল দেখিলে---আমার হাতে এই আধখানা লাঠি দেখিলো—তোমার ইচ্ছা থাকিলেও তুমি আমার উপর কোন অত্যাচার করিতে সাহস করিবে না।” হীরালাল চুপ করিয়া রহিল। সপতম পরিচ্ছেদ হীরালাল, জগন্নাথের ঘাটে গিয়া নৌকা করিল। রাত্রিকালে দক্ষিণা বাতাসে পাল দিল । সে বলিল, তাহদের পিত্ৰালয় হগলী। আমি তাহা জিজ্ঞাসা করিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম। পথে হীরালাল বলিল, “গোপালের সঙ্গে তোমার বিবাহ ত হইবে না—আমায় বিবাহ কর।” আমি বলিলাম, “না”। হীরালাল বিচার আরম্ভ করিল। তাহার যত্ন যে, বিচারের দবারা প্রতিপন্ন করে যে, তাহার ন্যায়। সৎপাত্র পথিবীতে দলভ ; আমার ন্যায়। কুপাত্ৰীও পথিবীতে দলভ। আমি উভয়ই স্বীকার করিলাম--তথাপি বলিলাম যে, “না, তোমাকে বিবাহ করিব না।” তখন হীরালাল বড় ক্লদ্ধ হইল। বলিল, “কাণাকে কে বিবাহ করিতে চাহে ?” এই বলিয়া নীরব হইল। উভয়ে নীরবে রহিলাম—এইরনুপে রাত্ৰি কাটিতে লাগিল । তাহার পরে, শেষ রাত্রে, হীরালাল অকস্মাৎ মাঝিদিগকে বলিল, “এইখানে ভিড়ো।” মাঝিরা নৌকা লাগাইল-নৌকাতলে ভূমি সপশোর শব্দ শানিলাম। হীরালাল আমাকে বলিল, “নাম-আসিয়াছি।”—সে আমার হাত ধরিয়া নামাইল। আমি কলে দাঁড়াইলাম। তাহার পর শব্দ শানিলাম, যেন হীরালাল আবার নৌকায় উঠিল। মাঝিদিগকে বলিল, “দে, নৌকা খলিয়া দে।” আমি বলিলাম, “সে কি ? আমাকে নামাইয়া দিয়া নৌকা খলিয়া দাও কেন ?” Gk ON