পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উপন্যাস-প্রসঙগ কুন্দনন্দিনীতে, সন্দরী এবং শৈবলিনীতে, ভ্রমর এবং রোহিণীতে আমরা কেবল সাধারণ নারীত্বের সাব্বজনীন মাত্তিই দেখি না, কিন্তু সাব্বজনীন নারীত্ব কোন আকারে কিরাপে বাংলার মাটি, বাংলার জলবায়, বাংলার ঘাট মাঠ, বাংলার নৈসগিক প্রকৃতি এবং পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের দ্বারা বিশিষ্ট হইয়া কোন কোন মাত্তিতে ফটিয়া উঠে, ইহাও প্রত্যক্ষ করি। প্রতিদিন যে পথে-ঘাটে বেড়াই, যে নদী-তরঙ্গ এবং সাঁঝের আকাশ দেখি, তাহাই যখন আলোক-ছবিতে কিম্বা সানিপািণ চিত্রকরের তুলিকায় ফটিয়া উঠে, তখন তাহার মধ্যে যে রােপ দেখিতে পাইক পেন্ডেব। তাহা দেখি নাই। আৰু দেখি নাই এইজন্য যে, সেদিকে কোনদিন লক্ষ্য করি নাই। এত সৌন্দয্যের ভিতরে যে প্ৰাতঃসন্ধ্যায় ঘরিয়া বেড়াই, ছবি দেখিবার পকেব। ইহা বঝি নাই। বঝি নাই বলিয়া তাহার ময্যাদা করি নাই। কিন্তু যেদিন ইহার ছবি দেখিলাম, সেদিন হইতে এই চিরপরিচিত পথ-ঘাটের দাম যেন বাড়িয়া গেল। ঠিক এইরূপে বিষবক্ষ, চন্দ্রশেখর এবং কৃষ্ণকান্তের উইল শিক্ষিত বাঙগালীর নিকটে তাহার সামাজিক এবং পারিবারিক জীবনের মাল্যাটা বাড়াইয়া দিল। এতদিন বাঙ্গালী ভাবিত যে য়ারোপীয় সমাজে এবং পাশ্চাত্য জাতীয় লোকদিগের পারিবারিক জীবনে যে রস ও আনন্দের উৎস উৎসারিত হইয়া উঠে, হতভাগ্য বাঙ্গালীজীবনে তাহা সম্পভাবে না। বিষবক্ষ প্রভৃতি উপন্যাস প্রচার করিয়া বঙ্কিমচন্দ্র শিক্ষিত বাঙ্গালীর চোখে আগুগল দিয়া দেখাইয়া দিলেন-বিবিধ রসের উৎস ও রসমাত্তির উপকরণ কেবল য়ারোপেই যে আছে তাহা নহে, বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে তাহা আছে।...এইভাবে এই তিনখানি উপন্যাসের সাহায্যে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলার নবযাগের নবীন সাধনাকে পরিপন্ট করিয়া তোলেন। দগেদীশ-নন্দিনী, কপালকুন্ডলা এবং মণিালিনীতে সাব্বজনীন মানব-প্রকৃতির স্বাভাবিক ভোগাধিকার প্রতিস্ঠা করিয়া বণ্ডিকমচন্দ্র বাঙগালীকে আত্ম-চরিতার্থতার পথে বাহিরের বন্ধন-মন্ত করিতে চেন্টা করেন। এই ভোগের পথ যে সোজা পথ নয়, বাহিরের বন্ধন ছিড়িলেই যে এই ভোগের পথে যাইয়া মানষি সম্যক আত্ম-চরিতার্থতা লাভ করিতে পারে না, এ পথে পদে পদে কত বিঘা কত বাধা, আত্ম-চরিতার্থতা লাভ করা দরে থাক, আত্মহত্যার যে কত আশঙ্কা,-বিষবক্ষে, চন্দ্রশেখরে এবং কৃষ্ণকান্তের উইলে তিনি তাহা বিশেষভাবে ফটাইয়া তুলিতে চেন্টা করেন। আধনিক য়ারোপীয় evolution বা অভিব্যক্তিবাদের ভাষায় দগেশনন্দিনী প্রভৃতিকে রসরাজ্যে মানবেবী আত্ম-চরিতার্থতার অভিব্যক্তিধারাতে thesis-এর অবস্থা বলা যায়। বিষবক্ষ প্রভৃতিকে এই অভিব্যক্তিধারাতে antithesis-এর অবস্থা বলা যায়। দগের্দশনন্দিনী প্রভৃতিতে সহজ রসবিলাপের ছবি দেখিতে পাই। এখানকার কথা সহজ। ভোগ। বিষবক্ষে, চন্দ্রশেখরে এবং কৃষ্ণবদান্তের উইলে ভোগের প্রবত্তির সঙ্গে সংযমের ও সমাজ-শাসনের একটা প্রবল বিরোধ ফটিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু এখানে কোনও সন্ধির কথা বা সমন্বয়ের সঙেকত নাই। বঙিকমচন্দ্র তাঁহার শেষ তিনখানি উপন্যাসে এই সন্ধি বা সমন্বয়ের প্রতিস্ঠা করিবার চেন্টা করেন। ইহাই আনন্দমঠ, দেবীচৌধরাণী এবং সীতারামের বিশেষত্ব। কেবল রসমাত্তির সন্টি করিবার উদ্দেশ্যে বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দমঠ, দেবীচৌধরাণী বা সীতারামের রচনায় প্রবত্ত হন নাই। এই তিনখানির উদ্দেশ্য ছিল সবদেশবাসীদিগকে ভারতের উচ্চাঙ্গের কৰ্ম্মযোগে দীক্ষিত করা।” (“নবযাগের বাংলা” পঃ ১৭৩-৭৫) শ্ৰীযোগেশচন্দ্র বাগল [ দ্রঅটব্য : এই অধ্যায় দুইটি রচনায় অন্যান্য পাস্তকের মধ্যে “বঙ্কিম-প্রসঙ্গ,” “বণ্ডিকম-জীবনী,” বঙগীয়-সাহিত্য-পরিষৎ কত্ত্বক প্রকাশিত সাহিত্য-সাধক-চরিতমালার অন্তগত “বণ্ডিকম চট্টোপাধ্যায়” এবং "বঙিকম গ্রন্থাবলী” হইতে বিশেষ সাহায্য লইয়াছি। সমসাময়িক পত্রপত্রিকা হইতেও তথ্যাদি সংগ্ৰহ করিতে হইয়াছে।--লেখক ] CS