পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দগেশনন্দিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ঃ আলাপ প্রথমে যািবক নিজ কৌতহলপরবশতা প্ৰকাশ করিলেন। বয়োজ্যোঠাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “অন্যভাবে বঝিতেছি, আপনারা ভাগবানের পরস্ত্রী, পরিচয় জিজ্ঞাসা করিতে সঙ্কোচ হইতেছে; কিন্তু আমার পরিচয় দেওয়ার পক্ষেীর্ষে প্রতিবন্ধক, আপনাদের সে প্রতিবন্ধকনা থাকিতে পারে, এজন্য জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করিতেছি।” জ্যেষ্ঠা কহিলেন, “সত্ৰীলোকের পরিচয়ই বা কি ? যাহারা কুলো পাধি ধারণ করিতে পারে না, তাহারা কি বলিয়া পরিচয় দিবে ? গোপনে বাস করা যাহাদিগের ধৰ্ম্মম , তাহারা কি বলিয়া আত্মপ্রকাশ করিবে ? যে দিন বিধাতা সত্ৰীলোককে স্বামীর নাম মাখে আনিতে নিষেধ করিয়াছেন, সেই দিন আত্মপরিচয়ের পথও বন্ধ করিয়াছেন।” যািবক এ কথার উত্তর করিলেন না। তাঁহার মন অন্য দিকে ছিল। নবীনা রমণী ক্ৰমে ক্ৰমে অবগন্ঠনের কিয়দংশ অপসতুত করিয়া সহচরীর পশ্চাদভাগ হইতে অনিমেষচক্ষতে যাবকের প্রতি দলিট করিতেছিলেন। কথোপকথনমধ্যে অকস্মাৎ পথিকেরও সেই দিকে দণ্টিপাত হইল ; আর দটি ফিরিলী না; তাঁহার বোধ হইল, যেন তােদশ অলৌকিক রপরাশি আর কখন দেখিতে পাইবেন না। যাবতীর চক্ষদ্বয়ের সহিত পথিকের চক্ষ সংমিলিত হইল। যাবতী অমনি লোচনষগল বিনত করিলেন। সহচরী বাক্যের উত্তর না পাইয়া পথিকের মািখপানে চাহিলেন। কোন দিকে তাঁহার দলিট, তাহাও নিরীক্ষণ করিলেন, এবং সমভিব্যাহারিণী যে যােবক প্রতি সত্যুষ্ণনয়নে চাহিতেছিলেন, তাহা জানিতে পারিয়া, নবীনার কানে কানে কহিলেন, “কি লো! শিবসাক্ষাৎ সস্বয়ম্বারা হবি না কি ?” নবীনা, সহচরীকে অঙ্গলিনিপীড়িত করিয়া, তদ্রােপ মদ স্বরে কহিল, “তুমি নিপাত যাও।” চতুরা সহ চারিণী এই দেখিয়া মনে মনে ভাবিলেন যে, যে লক্ষণ দেখিতেছি, পাছে এই অপরিচিত যােবা পরিষের তেজঃপঞ্জ কান্তি দেখিয়া আমার হস্তসমপিতা এই বালিকা মন্মথশরজালে বিদ্ধ হয়; তবে আর কিছ হউক না হউক, ইহার মনের সখি চিরকালের জন্য নন্ট হইবে, অতএব সে পথ এখনই রন্ধ করা আবশ্যক। কিরাপেই বা এ অভিপ্রায় সিদ্ধ হয় ? যদি ইঙিগতে বা ছলনাক্ৰমে যািবককে স্থানান্তরে প্রেরণ করিতে পারি, তবে তাহা কৰ্ত্তব্য বটে, এই ভাবিয়া নারীস্বভাব সিদ্ধ চতুরতার সহিত কহিলেন, “মহাশয়! সত্রিীলোকের সনাম এমনই অপদাৰ্থ বস্তু যে, বাতাসের ভর সহে না। আজিকার এ প্রবল ঝড়ে রক্ষা পাওয়া দন্ডকর, অতএব এক্ষণে ঝড় থামিয়াছে, দেখি যদি আমরা পদব্রজে বাটী গমন করিতে পারি।” যােবা পরষ উত্তর করিলেন, “যদি একান্ত এ নিশীথে আপনারা পদব্রজে যাইবেন, তবে আমি আপনাদিগকে রাখিয়া আসিতেছি। এক্ষণে আকাশ পরিস্কার হইয়াছে, আমি এতক্ষণ নিজস্থানে যাত্ৰা করিতাম, কিন্তু আপনার সখীর সদশ রােপসীকে বিনা রক্ষকে রাখিয়া যাইব না বলিয়াই এখন এ সন্থানে আছি।” কামিনী উত্তর করিল, “আপনি আমাদিগের প্রতি যেরােপ দয়া প্রকাশ করিতেছেন, তাহাতে পাছে আমাদিগকে অকৃতজ্ঞ মনে করেন, এজন্যই সকল কথা ব্যক্ত করিয়া বলিতে পারিতেছি না। মহাশয়! সত্ৰীলোকের মন্দ কপালের কথা আপনার সাক্ষাতে আর কি বলিব। আমরা সহজে অবিশবাসিনী ; আপনি আমাদিগকে রাখিয়া আসিলে আমাদিগের সৌভাগ্য, কিন্তু যখন আমার প্রভু—এই কন্যার পিতা-ইহাকে জিজ্ঞাসা করিবেন, তুমি এ রাত্রে কাহার সঙ্গে আসিয়াছ, তখন ইনি কি উত্তর করিবেন ?” যােবক ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, “এই উত্তর করিবেন যে, আমি মহারাজ মানসিংহের পত্র জগৎ সিংহের সঙ্গে আসিয়াছি।” যদি তন্ম হত্তে মন্দিরমধ্যে বজপতন হইত, তাহা হইলেও মন্দিরবাসিনী সত্ৰীলোকেরা অধিকতর চমকিত হইয়া উঠিতেন না। উভয়েই অমনি গাত্রোথনি করিয়া দন্ডায়মান হইলেন। কনি✉ঠা শিবলিঙ্গের পশ্চাতে সরিয়া গেলেন। বাগবিদগধা বয়োধিক গলদেশে অঞ্চল দিয়া দন্ডবৎ হইলেন; অঞ্জলিবদ্ধকরে কহিলেন, “যদুবরাজ ! না জানিয়া সহস্র অপরাধ করিয়াছি, অবোধ সত্ৰীলোকদিগকে নিজগণে মাজজনা করিবেন।” (t(