পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৭৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VON of FMary বাটিকা মাটিতে পড়িয়া রহিল। কল্যাণী নদী হইতে আচিল ভিজাইয়া জল আনিয়া মেয়ের মখে দিলেন। অতি সকাতরে মহেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “একটা কি পেটে গেছে ?” মন্দটাই আগে বাপ-মার মনে আসে-যেখানে অধিক ভালবাসা, সেখানে ভয়ই অধিক প্রবল । মহেন্দ্র কখন দেখেন নাই যে, বাড়িটা আগে কত বড় ছিল। এখন বাড়িটা হাতে লইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন, “বোধ হয় অনেকটা খাইয়াছে।” কল্যাণীরও কাজেই সেই বিশ্বাস হইল। অনেকক্ষণ ধরিয়া তিনি বড়ি হাতে লইয়া নিরীক্ষণ করিলেন। এদিকে, মেয়ে যে দই এক ঢোক গিলিয়ছিল, তাহারই গণে কিছ: বিকৃতাবস্থা প্রাপ্ত হইল। কিছ ছটফট করিতে লাগিল—কাঁদিতে লাগিল—শেষ কিছর অবসন্ন হইয়া পড়িল। তখন কল্যাণী স্বামীকে বলিলেন, “আর দেখা কি ? যে পথে দেবতায় ডাকিয়াছে, সেই পথে সকুমারী চলিল-আমাকেও যাইতে হইবে।” এই বলিয়া, কল্যাণী বিষের বড়ি মসুখে ফেলিয়া দিয়া মহত্তমধ্যে গিলিয়া ফেলিলেন। মহেন্দ্র রোদন করিয়া বলিলেন, “কি করিলে—কল্যাণী, ও কি করিলে ? কল্যাণী কিছ উত্তর না করিয়া স্বামীর পদধলি মস্তকে গ্রহণ করিলেন ; বলিলেন, “প্ৰভু, কথা কহিলে কথা বাড়িবে, আমি চলিলাম।” “কল্যাণী, কি করিলে?” বলিয়া মহেন্দ্র চীৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। অতি মদাসত্বরে কল্যাণী বলিতে লাগিলেন, “আমি ভালই করিয়াছি। ছাঁর সত্ৰীলোকের জন্য পাছে তুমি দেবতার কাজে অযত্ন করা! দেখি, আমি দেববাক্য লঙঘন করিতেছিলাম, তাই আমার মেয়ে গেল। আর অবহেলা করিলে পাছে তুমিও যাও।” মহেন্দ্ৰ কাদিয়া বলিলেন, “তোমায় কোথাও রাখিয়া আসিতাম—আমাদের কাজ সিদ্ধ হইলে আবার তোমাকে লইয়া সখী হাইতাম । কল্যাণী, আমার সব! কেন তুমি এমন কাজ করিলে! যে হাতের জোরে আমি তরবারি। ধরিতাম, সেই হােতই ত কাটিলে! তুমি ছাড়া আমি কি!” কল্যাণী। কোথায় আমায় লইয়া যাইতে—স্থান কোথায় আছে ? মা, বাপ, বন্ধবেগ, এই দারণ দঃসময়ে সকলি তা মরিয়াছে। কার ঘরে স্থান আছে, কোথায় যাইবার পথ আছে, কোথায় লাইয়া যাইবে ? আমি তোমার গলগ্ৰহ । আমি মরিলাম, ভালই করিলাম। আমায় আশীবাবােদ কর, যেন আমি সেই--সেই আলোকময় লোকে গিয়া আবার তোমার দেখা পাই। এই বলিয়া কল্যাণী আবার স্বামীর পদরেণ গ্রহণ করিয়া মাথায় দিলেন। মহেন্দ্র কোন উত্তর না করিতে পারিয়া আবার কাঁদিতে লাগিলেন। কল্যাণী আবার বলিলেন,-অতি মদ, অতি মধর, অতি স্নেহময় কণঠ–আবার বলিলেন, “দেখ, দেবতার ইচ্ছা কার সাধ্য লঙ্ঘন করে ? আমায় দেবতায় যাইতে আজ্ঞা করিয়াছেন, আমি মনে করিলে কি থাকিতে পারি—আপনি না মরিতাম ত অবশ্য আর কেহ মারিত। আমি মরিয়া ভালই করিলাম। তুমি যে ব্রত গ্রহণ করিয়াছ, কায়মনোবাক্যে তাহা সিদ্ধ করা, পণ্য হইবে। আমার তাহাতে সবগ লাভ হইবে। দই জন একত্রে অনন্ত সবগ ভোগ করিব।” এদিকে বালিকাটি একবার দধে তুলিয়া সামলাইল। তাহার পেটে বিষ যে অলপ পরিমাণে গিয়াছিল, তাহা মারাত্মক নহে। কিন্তু সে সময় সে দিকে মহেন্দ্রের মন ছিল না। তিনি কন্যাকে কল্যাণীর কোলে দিয়া উভয়কে গাঢ় আলিঙ্গন করিয়া অবিরত কাঁদিতে লাগিলেন। তখন যেন অরণ্যমধ্য হইতে মন্দ অথচ মেঘগম্ভীর শবদ শনা গেল। “হরে মর্যারে মধকৈটভারে । গোপাল গোবিন্দ মকুন্দশৌরে।” কল্যাণীর তখন বিষ ধরিয়া আসিতেছিল, চেতনা কিছ. অপহৃত হইয়াছিল; তিনি মোহভরে শনিলেন, যেন সেই বৈকুণ্ঠে শ্ৰত অপব্ব বংশীধবনিতে বাজিতেছিলঃ “হরে মর্যারে মধকৈটভারে । গোপাল গোবিন্দ মকুন্দশৌরে।” তখন কল্যাণী অপসরোনিন্দিত কণ্ঠে মোহভরে ডাকিতে লাগিলেন, “হরে মর্যারে, মধকৈটভারে।”