পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৭৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७ान्म●èट) বাঁচাইয়া তাহাকে অতি কদায্য ভাষায় গালি দিতে দিতে (বিলম্বের অপরাধ তার) এখন আসিতেছিলেন। দেখিলেন, প্রভুকে মসলমানে ধরিয়া লইয়া যাইতেছে—প্ৰভু গান গায়িতে গায়িতে চলিয়াছেন। ו জীবানন্দ মহাপ্ৰভু সত্যানন্দের সঙ্কেত সকল বঝিতেন। বসতি বনে বরনারী।” নদীর ধারে আবার কোন মাগী না খেয়ে পড়িয়া আছে না কি ? ভাবিয়া চিন্তিয়া, জীবানন্দ নদীর ধারে ধারে চলিলেন। জীবানন্দ দেখিয়াছিলেন যে, ব্রহ্মচারী স্বয়ং মসলমান কর্তৃক নীতি হইতেছেন। এস্থলে ব্রহ্মচারীর উদ্ধারই তাঁহার প্রথম কাজ। কিন্তু জীবানন্দ ভাবিলেন, “এ সঙেকতের সে অর্থ নয়। তাঁহার জীবনরক্ষার অপেক্ষাও তাঁহার আজ্ঞা পালন বড়—এই তাঁহার কাছে প্রথম শিখিয়াছি। অতএব তাঁহার আজ্ঞােপালনই করিব।” নদীর ধারে ধারে জীবানন্দ চলিলেন। যাইতে যাইতে সেই বােক্ষতলে নদীতীরে দেখিলেন। যে, এক সত্ৰীলোকের মতদেহ আর এক জীবিত শিশৱকন্যা। পাঠকের সমরণ থাকিতে পারে, মহেন্দ্রের সত্ৰী কন্যাকে জীবানন্দ একবারও দেখেন নাই। মনে করিলেন, হইলে হইতে পারে যে, ইহারাই মহেন্দ্রের সত্ৰী কন্যা। কেন না, প্রভুর সঙ্গে মহেন্দ্রকে দেখিলাম। যাহা হউক, মাতা মতা, কন্যাটি জীবিতা। আগে ইহার রক্ষাবিধান করা চাই-নিহিলে বাঘ-ভালকে খাইবে। এইখানেই কোথায় আছেন, তিনি সত্ৰীলোকটির সৎকার করিবেন, এই ভাবিয়া বালিকাকে কোলে তুলিয়া লইয়া চলিলেন। মেয়ে কোলে তুলিয়া জীবানন্দ গোঁসাই সেই নিবিড় জঙ্গলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। জগুগল পার হইয়া একখানি ক্ষদ্র গ্রামে প্রবেশ করিলেন। গ্রামখানির নাম ভৈরবীপর। লোকে বলিত ভরইপাের। ভরইপরে কতকগলি সামান্য লোকের বাস, নিকটে আর বড় গ্রাম নাই, গ্রাম পার হইয়াই আবার জঙ্গল। চারি দিকে জঙ্গল—জঙ্গলের মধ্যে একখানি ক্ষদ্র গ্রাম, কিন্তু গ্রামখানি বড় সন্দর। কোমলতৃণাবত গোচারণভূমি; কোমল শ্যামল পল্লবযক্তি আম, কাঁটাল জাম, তালের বাগান; মাঝে নীল জলপারিপািণ স্বচ্ছ দীঘি কা। তাহাতে বক, হংস, ডাহক; তীরে কোকিল, চক্ৰবাক ; কিছ দ্বরে ময়র উচ্চারবে কেকাধবনি করিতেছে। গহে গহে, প্রাঙ্গণে গাভী, গাহের মধ্যে মরাই, কিন্তু আজকাল দাভিক্ষে ধান নাই—কাহারও চালে একটি ময়নার পিজারে, কাহারও দেওয়ালে আলিপনা-কাহারও উঠানে শাকের ভূমি। সকলই দভিক্ষপীড়িত, কৃশ, শীণ্যু, সন্তাপিত। তথাপি এই গ্রামের লোকের একটা শ্ৰীছাঁদ আছে—জওগলে অনেক রকম মন:ষ্যখাদ্য জন্মে, এজন্য জঙ্গল হইতে খাদ্য আহরণ করিয়া সেই গ্রামবাসীরা প্রাণ ও সর্বাস্থ্য রক্ষা করিতে পারিয়াছিল। একটি বহৎ আম্রকানানমধ্যে একটি ছোট বাড়ী। চারি দিকে মাটির প্রাচীর, চারি দিকে চারিখানি ঘর। গহসেথর গোর আছে, ছাগল আছে, একটা ময়র আছে, একটা ময়না আছে, একটা টিয়া আছে। একটা বাঁদর ছিল, কিন্তু সেটাকে আর খাইতে দিতে পারে না বলিয়া ছাড়িয়া দিয়াছে। একটা ঢেকি আছে, বাহিরে খামার আছে, উঠানে লেবগাছ আছে, গোটাকতক মল্লিকা যাইয়ের গাছ আছে, কিন্তু এবার তাতে ফল নাই। সব ঘরের দাওয়ায় একটা একটা চরকা আছে; কিন্তু বাড়ীতে বড় লোক নাই। জীবানন্দ মেয়ে কোলে করিয়া সেই বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিল। বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিয়াই জীবানন্দ একটা ঘরের দাওয়ায় উঠিয়া একটা চরকা লইয়া ঘেনর ঘেনর আরম্ভ করিলেন। সে ছোট মেয়েটি কখন চরকার শবদ শানে নাই। বিশেষতঃ মা ছাড়া হইয়া অবধি কাঁদিতেছে, চরকার শবদ শনিয়া ভয় পাইয়া আরও উচ্চ সপতাকে উঠিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল। তখন ঘরের ভিতর হইতে একটি সতের কি আঠার বৎসরের মেয়ে বাহির হইল। মেয়েটি বাহির হইয়াই দক্ষিণ গন্ডে দক্ষিণ হস্তের অঙ্গলি সন্নিবিষ্ট করিয়া ঘাড় বাঁকাইয়া দাঁড়াইল। “এ কি এ ? দাদা চরকা কাটো কেন ? মেয়ে কোথা পেলে ? দাদা, তোমার মেয়ে হয়েছে না। কি—আবার বিয়ে করেছ না কি ?” Գ ՕԳ 86