পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৭৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বঙ্কিম | রচনাবলী রঙগ দেখিবার জন্য সে সত্ৰীলোক শাড়িখানি বাহির করিল। রঙগ দেখিবার জন্য,-কেন না, এত দঃখেও রঙগ দেখিবার যে বত্তি, তাহা তাহার হৃদয়ে লািপত হয় নাই। নবীন যৌবন, ফাল্লকমলতুল্য তাহার নবরসের সৌন্দয্য; তৈল নাই,--বেশ নাই—আহার নাই—তব, সেই প্ৰদীপত, অনন মেয় সৌন্দৰ্য্য সেই শতগ্রন্থিযক্ত বসনমধ্যেও প্রস্ফটিত। বর্ণে ছায়ালোকের চাঞ্চল্য, নয়নে কটাক্ষ, অধরে হাসি, হৃদয়ে ধৈৰ্য্য। আহার নাই-তব শরীর লাবণ্যময়, বেশভূষা নাই, তব সে সৌন্দৰ্য্য সম্পপণ্য অভিব্যক্ত। যেমন মেঘমধ্যে বিদ্যুৎ, যেমন মনোমধ্যে প্রতিভা, যেমন জগতের শবদমধ্যে সঙ্গীত, যেমন মরণের ভিতর সখি, তেমনি সে রােপরাশিতে অনিকবচনীয় কি ছিল! অনিন্মবাচনীয় মাধ্যায্য, অনিববচনীয় উন্নতিভাব, অনিববচনীয় প্ৰেম, অনিববচনীয় ভক্তি! সে হাসিতে হাসিতে (কেহ সে হাসি দেখিল না) হাসিতে হাসিতে সেই ঢাকাই শাড়ি বাহির করিয়া দিল। বলিল, “কি লো নিমি, কি হইবে ?” নিমাই বলিল, “তুই পরাবি।“ সে বলিল, “আমি পরিলে কি হইবে ?” তখন নিমাই তাহার কমনীয় কন্ঠে আপনার কমনীয় বাহ বেন্টন করিয়া বলিল, ‘দাদা এসেছে, তোকে যেতে বলেছে।” সে বলিল, “আমায় যেতে বলেছেন ত ঢাকাই শাড়ি কেন ? চল না। এমনি যাই।” নিমাই তার গালে এক চড় মারিল —সে নিমাইয়ের কাঁধে হাত দিযা তাহাকে কুটীরের বাহির করিল। বলিল, “চল, এই ন্যাকড়া পরিয়া তাঁহাকে দেখিয়া আসি।” কিছতেই কাপড় বদলাইল না, অগত্যা নিমাই রাজি হইল। নিমাই তুহাকে সঙ্গে লইয়া আপনার বাড়ীর দুবার পর্যন্ত গেল, গিয়া তাহাকে ভিতরে প্রবেশ করাইয়া ‘দবার রদ্ধ করিয়া। আপনি দবারে দাঁড়াইয়া রহিল। ষোড়শ পরিচ্ছেদ সে সত্ৰীলোকের বয়স প্রায় পাঁচিশ বৎসর, কিন্তু দেখিলে নিমাইয়ের অপেক্ষা অধিকবয়স্কা বলিয়া বোধ হয় না। মলিন গ্রন্থিযক্ত বসন পরিয়া সেই গহমধ্যে প্রবেশ করিলে, বোধ হইল, যেন, গহ আলো হইল। বোধ হইল, পাতায় ঢাকা কোন গাছের কত ফলের কুড়ি ছিল, হঠাৎ ফটিয়া উঠিল; বোধ হইল যেন, কোথায় গোলাপজলের কাবাবা মাখ অাঁটা ছিল, কে কাববা ফেলিল। যেন কে প্রায় নিবান আগনে ধপ-ধােনা গগঙ্গল ফেলিয়া দিল। সে রােপসী ܟܘ\ গহমধ্যে প্রবেশ করিয়া ইতস্ততঃ স্বামীর অন্বেষণ করিতে লাগিল, প্রথমে ত দেখিতে পাইল না। তার পর দেখিল, গহপ্রাঙ্গণে একটি ক্ষদ্ৰ বােক্ষ আছে, আমের কান্ডে মাথা রাখিয়া জীবানন্দ কাঁদিতেছেন। সেই রূপসী তাঁহার নিকটে গিয়া ধীরে ধীরে তাঁহার হস্তধারণ করিল। বলি না। যে, তাহার চক্ষে জল আসিল না, জগদীশবার জানেন যে, তাহার চক্ষে যে স্রোতঃ আসিয়াছিল, বহিলে তাহা জীবানন্দকে ভাসাইয়া দিত; কিন্তু সে তাহা বহিতে দিল না। জীবানন্দের হাত হাতে লইয়া বলিল, “ছি, কাঁদিও না ; আমি জানি, তুমি আমার জন্য কাঁদিতেছ, আমার জন্য তুমি কাঁদি ও না—তুমি যে প্রকারে আমাকে রাখিয়াছ, আমি তাহাতেই সখী।” জীবানন্দ মাথা তুলিয়া চক্ষ মাছিয়া স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “শান্তি! তোমার এ শতগ্রন্থি মলিন বস্ত্র কেন ? তোমার তা খাইবার পরিবার অভাব নাই।” শান্তি বলিল, “তোমার ধন, তোমারই জন্য আছে। আমি টাকা লইয়া কি করিতে হয়, তাহা জানি না। যখন তুমি আসিবে, যখন তুমি আমাকে আবার গ্রহণ করিবে—” জীব। গ্ৰহণ করিব—শান্তি ! আমি কি তোমায় ত্যাগ করিয়াছি ? শান্তি। ত্যাগ নাহে—যবে তোমার ব্ৰত সাঙগ হইবে, যাবে। আবার আমায় ভালবাসিবেকথা শেষ না হইতেই জীবানন্দ শান্তিকে গাঢ় আলিঙ্গন করিয়া, তাহার কাঁধে মাথা রাখিয়া অনেকক্ষণ নীরব হইয়া রহিলেন । দীঘ নিশবাস ত্যাগ করিয়া শেষে বলিলেন, “কোন দেখা করিলাম !” h শান্তি। কেন করিলে—তোমাব ত ব্ৰতভঙগ করিলে ? জীবা। ব্রতভঙ্গ হউক—প্ৰায়“িচত্ত আছে। তাহার জন্য ভাবি না, কিন্তু তোমায় দেখিয়া ত আর ফিরিয়া যাইতে পারিতেছি না। আমি এই জন্য নিমাইকে বলিয়াছিলাম যে, দেখায় কাজ নাই। তোমায় দেখিলে আমি ফিরিতে পারি না। এক দিকে ধৰ্ম্মম , অর্থ, কাম, মোক্ষী, জগৎসংসার ; এক দিকে ব্রত, হোম, যাগ, যজ্ঞ ; সবই এক দিকে আর এক দিকে তুমি। একা তুমি। GSO