পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৮৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দেবী চৌধরাণী দেবী বলিল, “ভাল কি মন্দ, বিবেচনা করিয়া দেখা। যাহা যাহা করিতে হইবে, তোমাকে বলিয়া দিতেছি। তোমার উপর সব নিভাির।” পণ8ম পরিচ্ছেদ পিপীলিকাশ্রেণীবৎ বরকন্দাজের দল ত্রিস্রোতার তীর-বন সকল হইতে বাহির হইতে লাগিল। মাথায় লাল পাগড়ি, মালকোঁচামারা, খালি পা—জলে লড়াই করিতে হইবে বলিয়া কেহ জােতা আনে নাই। সবার হাতে ঢাল-সাঁড়কি—কাহারও কাহারও বন্দকে আছে—কিন্তু বন্দকের ভাগ অলপ। সকলেরই পিঠে লাঠি বাঁধা—এই বাঙগালার জাতীয় হাতিয়ার। বাঙ্গালী ইহার প্রকৃত ব্যবহার জানিত; লাঠি ছাড়িয়াই বাঙ্গালী নিজজীব হইয়াছে। বরকন্দাজেরা দেখিল, ছিপাগলি প্রায় আসিয়া পড়িয়াছে—বজরা ঘেরিবে! বরকেন্দাজ দৌড়াইল—“রাণীজি-কি-জয়” বলিয়া তাহারাও বজরা ঘেরিতে চলিল। তাহারা আসিয়া আগে বজরা ঘেরিল—ছিপ তাহদের ঘেরিল । আর যে সময়ে শাঁকি বাজিল, ঠিক সেই সময়ে জন কত বরকন্দাজ আসিয়া বজরার উপর উঠিল। তাহারা বজরার মাঝি-মাল্লা—নৌকার কাজ করে, আবশ্যকমত লাঠি-সড়কিও চালায়। তাহারা আপাততঃ লড়াইয়ে প্রবত্ত হইবার কোন ইচ্ছা! দেখাইল না। দাঁড়ে হলে, পালের রসি ধরিয়া, লাগি ধরিয়া, যাহার যে সস্থান, সেইখানে বসিল । আরও অনেক বীরকন্দাজ বজরায় উঠিল। তিন চারি শ বরকন্দাজ তীরে রহিল—সেইখান হইতে ছিপের উপর সড়কি চালাইতে লাগিল। কতক সিপাহী ছিপ হইতে নামিয়া, বন্দকে সঙ্গীন চড়াইয়া তাহদের আক্ৰমণ করিল। যে বরাকান্দাজেরা বজরা ঘেরিয়া দাঁড়াইয়াছিল, অবশিস্ট সিপাহীরা তাহদের উপর পড়িল । সববািন্ত্ৰ হাতাহাতি লড়াই হইতে লাগিল। তখন মারামারি, কাটাকাটি, চোঁচাচোঁচ, বন্দকের হাড়মড়, লাঠির ঠক ঠকি, ভারি হলস্থল পড়িয়া গেল ; কেহ কাহারও কথা শনিতে পায় না।-- কেহ কোন সথানে স্থির হইতে পারে না। দর হইতে লড়াই হইলে সিপাহীর কাছে লাঠিয়ালেরা অধিকক্ষণ টিকিত না-কেন না, দরে লাঠি চলে না। কিন্তু ছিপের উপর থাকিতে হওয়ায় সিপাহীদের বড় অসবিধা হইল। যাহারা তীরে উঠিয়া যাদ্ধ করিতেছিল, সে সিপাহীরা লাঠিয়ালদিগকে সঙ্গীনের মখে হাঁটাইতে লাগিল, কিন্তু যাহারা জলে লড়াই করিতেছিল, তাহারা বরকন্দােজদিগের লাঠি-সড়কিতে হাত পা মাথা ভাঙিগয়া কাব্য হইতে লাগিল। প্রফতুল্ল নীচে আসিবার অলপমাত্র পরেই এই ব্যাপার আরম্ভ হইল। প্ৰফল্ল মনে করিল, “হয় ভবানী ঠাকুরের কাছে আমার কথা পৌছে নাই—নয় তিনি আমার কথা রাখিলেন না; মনে করিয়াছেন, আমি মরিতে পারিব না। ভাল, আমার কাজটাই তিনি দেখােন ৷” দেবীর রাণীগিরিতে গাটিকতক চমৎকার গণ জন্মিয়াছিল। তার একটি এই যে, যে সামগ্রীর কোন প্রকার প্রয়োজন হইতে পারে, তাই। আগে গছাইয়া হাতের কাছে রাখিতেন। এ গণের পরিচয় অনেক পাওয়া গিয়াছে। দেবী এখন হাতের কাছেই পাইলেন-একটি সাদা নিশান । সাদা নিশানটি বাহিরে লইয়া গিয়া স্বহস্তে উচু করিয়া ধরিলেন। সেই নিশান দেখিবামাত্র লড়াই একেবারে বন্ধ হইল। যে যেখানে ছিল, সে সেইখানেই হাতিয়ার ধরিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ঝড়-তুফান যেন হঠাৎ থামিয়া গেল, প্ৰমত্ত সাগর যেন অকস্মাৎ প্রশান্ত হদে পরিণত হইল । দেবী দেখিল, পাশে ব্রজেশবের। এই যমুদ্ধের সময়ে দেবীকে বাহিরে আসিতে দেখিয়া, ব্রজেশবেরও সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছিল। দেবী তাঁহাকে বলিল, “তুমি এই নিশান এইরহপ ধরিয়া থােক। আমি ভিতরে গিয়া নিশি ও দিবার সঙ্গে একটা পরামর্শ আটিব । রঙগরাজ যদি এখানে আসে, তাহাকে বলিও, সে দরওয়াজা হইতে আমার হকুম লয়।” এই বলিয়া দেবী ব্ৰজেশবরের হাতে নিশান দিয়া চলিয়া গেল। ব্রজেশবের নিশান তুলিয়া ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ইতিমধ্যে সেখানে রঙগরাজ আসিয়া উপস্থিত হইল । রঙগরাজ ব্রজেশবরের হাতে সাদা নিশান দেখিয়া, চোখ ঘরাইয়া বলিল, “তুমি কার হকুমে সাদা নিশান দেখাইলে ?” ব্রজ। রাণীজির হকুম। রঙ্গ। রাণীজির হকুম ? তুমি কে ? b"○ ○