পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৮৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দেবী চৌধরাণী শিকলে দোলান সোণার প্রদীপ। কিন্তু আজ একটা মসনদ নয়—ব্দইটা। দইটা মসনদের উপর সবৰ্ণমন্ডিত উপাধানে দেহ রক্ষা করিয়া দাইটি সন্দরী রহিয়াছে। তাহদের পরিধানে মহােঘ বস্ত্র, সব্বাঙ্গে মহামল্য রত্নভূষা। সাহেব তাদের চেনে না—রঙগরাজ চিনিল। চিনিল যে, একজন নিশি—আর একজন দিবা। সাহেবের জন্য একখানা রপোর চৌকি রাখা হইয়াছিল, সাহেব তাহাতে বসিলেন। রঙগরাজ খজিতে লাগিলেন, দেবী কোথা ? দেখিলেন, কামরার এক ধারে দেবীর সহজ বেশে দেবী দাঁড়াইয়া আছে, গড়া পরা, কেবল কড় হাতে, এলোচুল, কোন বেশভূষা নাই। সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে দেবী চৌধরাণী ? কাহার সঙ্গে কথা কহিব ?” নিশি বলিল, “আমার সঙেগ কথা কহিবেন। আমি দেবী।” দিবা হাসিল, বলিল, “ইংরেজ দেখিয়া রঙগ করিতেছিস ? এ কি রঙেগর সময় ? লেফটেনাণ্ট সাহেব ! আমার এ ভগিনি কিছ রঙগ-তামাশা ভালবাসে, কিন্তু এ তার সময় নয়। আপনি আমার সঙ্গে কথা কহিবেন--আমি দেবী চৌধরাণী।” নিশি বলিল, “আ মরণ! তুই কি আমার জন্য ফাঁসি যেতে চাস না কি ? সাহেবের দিকে ফিরিয়া নিশি বলিল, “সাহেব, ও আমার ভগিনী-বোধ হয়, স্নেহবশতঃ আমাকে রক্ষা করিবার জন্য আপনাকে প্রতারণা করিতেছে। কিন্তু কেমন করিয়া মিথ্যা প্রবণ8না করিয়া, বহিনের প্রাণদন্ড করিয়া, আপনার প্রাণ রক্ষা করিব ? প্রাণ অতি তুচ্ছ, আমরা বাঙ্গালীর মেযে, অক্লেশে ত্যাগ করিতে পারি। চলন, আমাকে কোথায় লইয়া যাইবেন, যাইতেছি। আমিই দেবী রাণী।” দিবা বলিল, “সাহেব! তোমার যিশ খ্রীস্টের দিব্য, তুমি যদি নিরপরাধিনীকে ধরিয়া লইয়া যাও । আমি দেবী ৷ ” সাহেব বিরক্ত হইয়া রঙগরাজকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কি তামাশা ? কে দেবী চৌধরাণী, তুমি যথাৰ্থ বলিবে ? রঙগরাজ কিছর বঝিল না, কেবল অনভব করিল যে, ভিতরে একটা কি কৌশল আছে । অতএব বন্ধি খাটাইয়া সে নিশিকে দেখাইয়া, হাতজোড় করিয়া বলিল, “হাজাের । এ-ই যথার্থ দেবী রাণী ৷ ” তখন দেবী প্রথম কথা কহিল। বলিল, “আমার ইহাতে কথা কহা বড় দোষ। কিন্তু কি জানি, এর পর মিছা কথা ধরা পড়িলে, যদি সকলে মারা যায়, তাই বলিতেছি, এ ব্যক্তি যাহ। বলিতেছে, তাহা সত্য নহে।” পরে নিশিকে দেখাইয়া বলিল, “এ দেবী নহে। যে উহাকে দেবী বলিয়া পরিচয় দিতেছে, সে রাণীজিকে মা বলে, রাণীজিকে মার মত ভক্তি করে, এই জন্য সে রাণীজিকে বাঁচাইবার জন্য অন্য ব্যক্তিকে নিশান দিতেছে।” তখন সাহেব দেবীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “দেবী। তবে কে?” দেবী বলিল, “আমি দেবী।” দেবী এই কথা বলিলে নিশিতে, দিবাতে, রঙগরাজ ও দেবীতে বড় গন্ডগোল বাধিয়া গেল। নিশি বলে, “আমি দেবী,” দিবা বলে, “আমি দেবী,” রঙগরাজ নিশিকে বলে, “এই দেবী,” দেবী বলে, “আমি দেবী।” বড় গোলমাল। তখন লেফটেনাণ্ট সাহেব মনে করিলেন, এ ফেরেববাজির একটা চড়ান্ত করা উচিত। বলিলেন, “তোমাদের দই জনের মধ্যে একজন দেবী চৌধরাণী বটে। ওটা চাকরাণী, ওটা দেবী নহে। এই দাই জনের মধ্যে কে সে পাপিঠা, তাহা তোমরা চাতুরী করিয়া আমাকে জানিতে দিতেছ না। কিন্তু তাহাতে তোমাদের অভিপ্রায় সিদ্ধ হইবে না। আমি এখন দাই জনকেই ধরিয়া লইয়া যাইব । ইহার পর প্রমাণের দ্বারা যে দেবী চৌধরাণী বলিয়া সাব্যস্ত হইবে, সেই ফাঁসি যাইবে। যদি প্রমাণের দবারা এ কথা পরিশুকনার না হয়, তবে দাই জনেই ফাঁসি যাইবে।” তখন নিশি ও দিবা দই জনেই বলিল, “এত গোলযোগে কাজ কি ? আপনার সঙ্গে কি গোইনদা নাই ? যদি গেইন্দা থাকে, তবে তাহাকে ডাকাইলেই ত সে বলিয়া দিতে পরিবো, – কে যথাৰ্থ দেবী চৌধরাণী।” হরিবল্লভকে বজরায় আনিবে, দেবীর এই প্রধান উদ্দেশ্য । হরিবল্লাভের রক্ষার ব্যবস্থা না করিয়া, দেবী আত্মরক্ষার উপায় করিবে না, ইহা স্থির। তাঁহাকে বজরায় না আনিতে পারিলে হরিবল্লাভের রক্ষার নিশ্চয়তা হয় না। : b'○○