পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/১২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

〉のこ。 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড বিভাগ কাজ করত। শুনলাম সে ছুটি নিয়ে এসেছিল। মার্চের পর পাক বাহিণীর পক্ষ হতে কাজে যোগ দেবার জন্য আবেদন আসে। কিন্তু বর্বর বাহিনীর সঙ্গে সে যোগ দেয়নি। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাকে বাংলা মাকে উদ্ধার করবার জন্য সে এতটুকু দ্বিধা বোধ করেনি। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সে যোগ দিয়েছিল। ঐ বাড়ীর ধারেই রাস্তা (বগুড়া- উল্লাপাড়া)। সাহস করে বসলাম এক গাছের ধারে। কিছুক্ষনের মধ্যে মোটরের শব্দ পেলাম।বুঝতে দেরী হলো না মিলিটারীদের গাড়ী আসছে। দেখলাম এক এক করে নয়াখানা গাড়ী পার হয়ে গেল। কোন গাড়ীতে শুধু দু-একটা পেট্রোলের ড্রাম। আবার কোন গাড়ীতে মিলিটারী ও গোলাগুলির বাক্স। হাটের দিন দু’একজন করে পাকা আম, কলা এসব নিয়ে যেত হাটে। ওরা জোর করে কেড়ে নিত, আম কলা ইত্যাদি, পয়সা চাইলে মারার ভয় দেখাত। পরের দিন ২৭শে মে দুপুরের পর আর এক গ্রামে পৌঁছলাম। সেখানে গিয়ে শুনলাম, যুবক ছেলেদের জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে। ভয় পেলাম শুনে। এ গ্রামে আসার পথে কিছুক্ষণ বড় রাস্তার উপর দিয়ে হটলাম খুব ভোরের দিকে। দেখলাম জুলিয়ে দেওয়া বহু বাড়ী। রাস্তা থেকে নেমে আধ মাইলের মত হেঁটে এসে বর্বরেরা পুড়িয়ে দিয়েছে বহু গ্রাম। রাস্তায় শুনলাম বাড়ী জুলিয়ে দেওয়ার কাহিনী। প্রথমে তারা নাকি কি একটা তরল পদার্থ ‘ম্প্রে’ করত। তারপর একটা সাদা কাঠির মত জিনিসে আগুন ধরিয়ে ফিকে মারত ঘরের মধ্যে। আগুন ধরে যেত সমস্ত ঘরে। খেয়াল-খুশী মত দু-একটা বাড়ীও তারা বাদ দিয়েছে। মনে হয় খেলেছে তারা, আগুন আগুন খেলা। যে গ্রামে আমরা থাকতাম, তার আশপাশের গ্রাম হতে ছেলেদেরকে ধরে নিয়ে গেছে। ধরে নিয়ে মিলিটারীরা না আসতে পারে সে জন্য গ্রামের লোকজন লাইন তুলে ফেলেছে। ফলে তাদেরকে হারাতে হয়েছে ঘরবাড়ী। মুক্তিবাহিনীর লোকেরা মাঝে মধ্যেই রেল লাইন, ব্রীজ উড়িয়ে দিত। একদিন মোহনপুরের কাছে এক গ্রামে, রাত্রিবেলা দুজন দালালকে মুক্তিবাহিনীর লোকেরা মেরে ফেলে। পরের দিন পাক সৈন্যরা সে গ্রাম জুলিয়ে দেয়। ২৬ মে জুন শনিবার আমি ও একজন লোক বগুড়া বাড়ী দেখবার জন্য রওনা হই। একটা বাস রাজশাহীর ও একটা বাস বগুড়ার ছিল। বাসে একটা পাঠান ব্যক্তি বাসের সমস্ত পয়সা নিত। কণ্ডাক্টরের হাতে লাগান ছিল শান্তি কমিটির লাল ব্যাচ। পথে মিলিটারীর যাতায়াত চোখে পড়ল। ১-৪৫ মিঃ বগুড়ার পুলিশ লাইনে গাড়ী সার্চ করবার জন্য থামান হয়। অনেকের সঙ্গে আমাকেও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কি করি, কোথায় থাকি ইত্যাদি। দেখলাম, পুলিশেরা রাইফেলের বট (দুইজন) উপর দিকে ও নল নিচের দিকে দিয়ে পাহারা দিচ্ছে। বগুড়া কারিগরি মহাবিদ্যালয়কে তারা ঘাঁটি বানিয়েছিল। শহরে ১৮% জন জনসাধারণ তখন এসেছে। দোকানপাট বন্ধ। রাস্তার দু পাশের দোকান, বাড়ীঘর পোড়ানো। যারা বাইরে থেকে শহরে আসে, তখনই কিছু জিনিসপত্র কিনে নিয়ে তারা চলে যায়। বগুড়া জেলা স্কুলও হয়েছিল তাদের ঘাঁটি। ঐ স্কুলের হোষ্টেলে বারান্দায় ব্যাটার চার্জ দেওয়া হতো। ষ্টেশনে কোন বাঙালীকে যেতে দেওয়া হতো না। বগুড়া পিটি স্কুলের কাছে নামলাম ২-১০ মিঃ। নেমে হেঁটে বাড়ীর দিকে আসছি। বাড়ীঘর পোড়া। রাস্তা জনমানবশূন্য। প্রায় ১ মাইল রাস্তার মধ্যে মাত্র ৪জন লোকের সঙ্গে দেখা হয়। রাস্তা চলতে ভয় ভয় হচ্ছিল। যেখানে একদিন ছিল উৎফুল্ল প্রানের স্পন্দন, আজ সেখানে শুধু পোড়া মাটির স্তুপ। দেখে কান্না এসে যাচ্ছিল।