পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/১৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১৭
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড

॥ ৭২॥
ফকির মামুদ মণ্ডল
গ্রাম-দানেজপুর
ডাঘর — পাঁচবিবি
থানা- পাঁচবিবি
জেলা-বগুড়া

 ১৯৭১ সালের বাংলা আষাঢ় মাসের ২০/২৫ তারিখে ৫০/৬০ জন রাজাকার পুলিশ বিহারী ও পাক মিলিটারী মিলে আমার বাসায় যায় এবং বাসা ঘেরাও করে এবং আমাকে বাসা হতে ধরে ফেলে। বাসার বাইরে নিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। তোমার চার নাতী মুক্তিযোদ্ধা তাদেরকে যদি তুমি এনে না দাও তাহলে আমরা তোমাকে গুলি করে হত্যা করবো। তার প্রতি উত্তরে আমি জবাব দেই তারা কোথায় গিয়েছে তা আমি বলতে পারবো না, আর আপনারা যদি তাদেরকে কোথাও খুঁজে পান তা হলে তাদেরকে আপনারা গুলি করে মেরে ফেলবেন আমার কোন আপত্তি থাকবে না। কিন্তু আমার নাতিরা কোথায় গিয়েছে তার জন্য তো আমি দায়ী হতে পারি না। কারণ তারা এখন বড় হয়েছে নিজ নিজ স্বাধীনতা নিয়ে তারা যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারে। আমি এখন বৃদ্ধ হয়েছি আর কি তাদের খোঁজখবর আমার পক্ষে রাখা সম্ভব। তারপর পাক হানাদার বাহিনীরা আমাকে চোখ বেঁধে পাঁচবিবি রেল লাইনের উপর নিয়ে আসে। এনেই স্থানীয় বিহারীদের নেতারা আলাপ আলোচনা করার পর চোখ বাঁধা অবস্থায় আমাকে রেল লাইনের উপর ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। আমি বাড়ী চলে যাই। ঐ ঘটনা ঘটার ৭/৮দিন পর আয়ুবের নির্দেশে ২০/২৫ জন রাজাকার বিহারী ও পাক সেনা মিলে আবার আমার গ্রামের বাসায় গিয়ে ঘেরাও করে আমাকে ধরে পাঁচবিবি নিয়ে আসে। এসেই সেই একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে, আমি আমার জবাবে একই কথা বলি। তারপর সেদিনও পাক হানাদার বাহিনী কুখ্যাত বিহারী নেতার সাথে আলাপ আলোচনা করে আমার চোখ বেঁধে সি,ও, অফিসের নিকট নিয়ে ছেড়ে দেয়। আমি বাড়ী চলে যাই। তারপর আমি আমার পরিবার পরিজনের সবাইকে নিয়ে ভারত চলে যাই। সেখানে আমার পরিবারের সকলকে রেখে ৮/১০ দিন পর আমি বাংলাদেশে চলে আসি। এর মধ্যে দালাল বিহারী নেতা আমার গদিঘর দখল করে নিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে সেখানে বসবাস করছিল।

 আষাঢ় মাসের শেষের দিকে পাক হানাদার বাহিনী পাঁচবিবি হতে কান্দি যাবার পথে কান্দিয়া ব্রীজে ৪/৫ টা চীনা মাইন ব্রীজ হতে উদ্ধার করে। এবং মাইন কারা পুঁতে রাখে তাদের খোঁজ করতে থাকে। কুখ্যাত আয়ুব পাক হানাদার বাহিনীকে জানিয়ে দেয় যে, উক্ত মাইন পাতার মূলে রয়েছে ছমির উদ্দিন মণ্ডল ও মামুদ মণ্ডল। শ্রাবন মাসের তিন তারিখে ৪০/৫০ জন পাক সেনা রাজাকার ও বিহারী মিলে আমাদের বাসায় যায় এবং বাসা ঘেরাও করে আমাকে এবং আমার ছোট ভাই ছমির উদ্দিন মণ্ডলকে ধরে দুই ভাই- এর হাত একত্র করে বেধে ঁকোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে পাঁচবিবি থানায় নিয়ে যায় এবং বলে ব্রীজে তোমার মাইন পুঁতেছিলে, তোমরা আমাদেরকে মেরে ফেলবে। তোমার চার নাতি মুক্তিযোদ্ধা তাদেরকে এনে দাও। নতুবা তোমাদের দুই ভাইকে গুলি করে হত্যা করবো। তারপর আমরা দুই ভাই মেজরকে বলি আমরা মাইন কেমন দেখা যায় চিনি না এবং মাইন পাতা সম্বন্ধে কিছুই বলতে পারবো না। আর আমার নাতীদের খোঁজখবর আমরা কিছুই বলতে পারবো না। তারপর আমাদের দুই ভাইকে মেজর পাঁচবিবি থানায় চালান দিয়ে যায়। পাঁচবিবি থানায় সেই সময় পাঞ্জাবী পুলিশেরা থাকতো এবং বিহারীরা থাকতো। আমাদের দুই ভাইকে থানার হাজতে রাখে। আমরা হাজতের মধ্যে ঢুকে দেখতে পাই মুজাফফর ন্যাপের একজন কর্মী নাম বছির মিয়া (বাড়ী আটুয়া পাঁচবিবি থানা) আধা মৃত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে। তাকে একজন পাঞ্জাবী পুলিশ এমন প্রহার করছে যে, প্রহারের দরুণ তার সমস্ত শরীর হতে রক্তপাত হচ্ছে। আমি জেলে ঢুকেই তাকে দেখে বললাম বছির মিয়া তুমি এখানে। বছির আমাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। আমি তাকে সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে বলি আল্লাহ আল্লাহ করো।