পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/১৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

> &ー) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড দিন ৬ ঘন্টা কাজ করতে হতো। সকাল ৮টা থেকে ১২টা এবং ৩টা থেকে ৫টা এক টানা কাজ করতে হতো এর ভিতর কোন বিশ্রাম নিতে দিতো না। সব সময় “ডবল” হিসাবে কাজ করাতো। এরপরও বর্বর সৈন্যরা চাবুক দিয়ে আমাদের প্রহার করতো। জেলখানার ভিতর যে ঘরে আমাদের রাখা হতো সে ঘরে খুব বেশী হলে ১০/১২ জন থাকতে পারে। সেখানে আমাদের ৬০ জনকে রাখতো। রাত্রিতে শোবার কোন ব্যবস্থা ছিল না। আমি যে ঘরে ছিলাম সে ঘরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার ডঃ কাজী সালেহ আহম্মেদ, লেকচারার মজিবর রহমান, ওয়াপদার ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার এম, ডি, ছারোয়ার হোসেন (রাজশাহী) ছিলেন। আমাদের মত এদের উপরও চলতো সমানভাবে নির্যাতন এবং আমাদের মত এদেরও কাজ করতে হতো। জেলের ভিতর সর্বমোট ১৫০ জন কয়েদী বন্দী ছিল। মোট ২৮/২৯ দিন আমি নাটোর জেলে ছিলাম। আমাদের খাবার দেবার জন্য জেল থেকে বের করে মার ছিল আমাদের একমাত্র সঙ্গী। প্রত্যেক দিন সকালে ছোট একটা পুরি ও একটু চা। দুপুরে দেয় ছটাক ছাউলের ভাত ও পানির মত একটু ডাউল অথবা একটু নিরামিশ তরকারী। বিকালে ২টা ছোট রুটি ও একটু আলুর ঝোল। কোন সময়ই আমাদের খাবার খেয়ে পেট ভরতো না। আমরা সবাই সব সময় ক্ষুধার জ্বালায় ভুগতাম। তাদের যখন জেলে ফিরিয়ে আনতো তখন তাদের দেহ ক্ষত বিক্ষত অবস্থায় দেখা যেত-সারা শরীর দিয়ে রক্ত ঝরতো। এত বিপদের মধ্যেও রাত্রির বেলা জেলখানার ভিতর আমরা গান বাজনা করতাম। কেউ গান গাইত কেউবা তালি বাজাত। এইভাবে আমরা আমাদের দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্ট করতাম। আমাদের কাছ থেকে চুক্তি পত্র লিখে নেওয়া হয় যে যদি পুনরায় ভারতে চলে যাই তবে আমার অবর্তমানে আমার পরিবারের উপর নির্যাতন চালানো হবে। জেলে থেকে আমাদের বের করে প্রত্যেককে ৫টা করে টাকা ও একটা করে সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়। মুক্তি পাবার পর আমি ৭ই সেপ্টেম্বর পাঁচবিবি হয়ে আমার বাড়ীতে পৌঁছি। মুক্তি পেয়ে আমি বাড়ী আসার পর প্রায়ই পাক বাহিনী আমাকে চাপ দিত রাজাকারে ভর্তি হবার জন্য অথবা বর্ডার স্পাইং করার জন্য। কিন্তু আমি অসুস্থ বলে বাড়ীতে থাকতাম এবং বলতাম যে আগে ভাল হয়ে নেই। ২৮ শে নভেম্বর বিকাল ৪টার দিকে একজন রাজাকার আমার বাড়ীতে গিয়ে বলে যে, এখনই থানায় যেতে হবে। আমি যদিও বুঝতে পারি যে আমাকে বন্দী করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তবুও আমি তার সঙ্গে থানায় রওনা হই কিন্তু রাস্তায় নেমে দেখতে পাই যে পাক বাহিনী গাড়ী নিয়ে আমার বাড়ীর দিকে যাচ্ছে। রাস্তার ভিতর থেকেই আমাকে তুলে নেয় এবং জয়পুরহাটে নিয়ে যায়। আমাকে যখন বন্দী করে গাড়ীতে তোলা হয় তখন গাড়ীর ভিতর লেঃ আলতাফ (বিহারী) বসে ছিল। আমাকে জয়পুরহাট বি, আই, ডি, সির শিক্ষানবীশ আবাসিক এলাকায় ২ নং ব্যারাকে পাক বাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যায়। এখানে আমাকে “মেজর আফজালের” কাছে নিয়ে যায় এবং লেঃ আলতাফ আমার নামে বহু মিথ্যা অভিযোগ মেজর সাহেবের কাছে বলে এবং বলে যে আমি নাকি ২ জন বিহারীকে হত্যা করেছি তা লেঃ আলতাফ দেখেছে। মেজর আমাকে এই সবকথার সত্যতা জিজ্ঞাসা করে। এক কথায় আমি সব অস্বীকার করি। তখন মেজর সাহেবের সঙ্গে আমার কিছুটা কথা কাটাকাটি হয়। এই সময় মেজর সাহেব একজন সৈন্যকে ডাকে এবং আমাকে ধোলাই দেবার জন্য বলে। এই সময় আমাকে এমনভাবে প্রহার করা হয় যে আমি প্রায় জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি।