পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/১৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৩৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড

॥ ৮৪ ॥
নারায়ন প্রসাদ
সৈয়দপুর বাজার
জেলা-রংপুর

 ২৭ শে মার্চ আমার বাবাকে বাড়ী থেকে ধরে কারফিউ চলাকালে সকাল বেলা একটি সামরিক জীপে করে ৪ জন সামরিক লোক এবং ২ জন স্থানীয় অবাঙ্গালী অস্ত্রসহ এসে নক করে। দরজা খুললে তারা বাড়ীতে ঢুকে সিন্দুক খুলে সমস্ত সোনাদানা, টাকা-পয়সা নেয় এবং বাড়ীতে অথবা দোকানে ওয়্যারলেস আছে বলে অভিযোগ করে। তাদের অভিযোগের সত্যতা প্রমাণের জন্য দোকান খুলেও দেখান হয়। পরিশেষে আমাকে একটি লাথি মেরে ফেলে দিয়ে আমার বাবাকে জীপে করে ক্যাণ্টনমেণ্টে নিয়ে যায়।

 ৯ই এপ্রিল বেলা সাড়ে এগারটার দিকে জনৈক অবঙ্গালী এসে আমাকে টেলিগ্রাফ অফিসে সামরিক কর্তৃপক্ষ ডাকছে বলে জানায়। সাথে আমার ছোট ভাইকেও নেবার নির্দেশ দেয়। ধৃত অবস্থায় আমার ছোট ভাই এবং আমাদেরই ভাড়াটে একজন স্বর্ণকারকে উল্লিখিত স্থানে জনৈক মেজরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। নামধাম জিজ্ঞাসা করার পর মেজর আমাদেরকে বন্দি করার নির্দেশ দেয়। তারপর থানায় নেয়া হয়। সেখানে কিছুক্ষণ পর ঐ টেলিগ্রাফ অফিসের সুপারিনটেনডেণ্ট (টিএগুটি) হাতিম আলী খালিফাকে ধরে আনে। রেলওয়ে ওয়ার্কশপ থেকে শ্রমিক ও চার্জম্যাসহ কিছু লোককে ধরে আনে। সর্বমোট ২৪-২৫ জনকে একত্রে বন্ধ ওয়াগনে করে কড়া সমারিক পাহারায় ক্যাণ্টনমেণ্টে নেয়া হয়। ক্যাণ্টনমেণ্টে নামানোর সাথে সাথে সকলের এক হাত করে বেঁধে দাউন গেঁথে স্থানীয় অবাঙ্গালী ও পাক সৈন্যরা বেদম প্রহার করা শুরু করে। বেল্ট, বেত, লাথি, চড়, কিল, ঘুষি এবং রাইফেলের বাঁট, বৈদ্যুতিক তার দিয়ে প্রহার করতে থাকে এবং বলতে থাকে “আচ্ছা চিজ মিলা”। মারের পর্ব শেষ হলে ক্যাণ্টনমেণ্টের ভিতরে ছোট ছোট ঘরে ১০-১২ জনকে একই ঘরে ঢুকায়।

 তারপর সকলকে আবার বারান্দায় বের করে দেয়ালের দিকে মুখ করে হাত দেয়ালের সাথে ফাঁক করে রেখে দাঁড় করায় এবং ঐ অবস্থায় ওয়াপদার মোটা বৈদ্যুতিক তার দিয়ে প্রহার করতে থাকে। এ অবস্থায় অত্যাচার চলার পর প্রাচীরের সাথে যে বাঁশ টাঙ্গানো ছিল সে বাঁশের সাথে কোমরে দড়ি বেঁধে উল্টো অবস্থায় টাঙ্গিয়ে দেয় এবং পিঠে প্রহার করতে থাকে। প্রহারের ফলে অজ্ঞান হলে অথবা অজ্ঞান হবার উপক্রম হলে ছেড়ে দেয়।

 এ সময় টিএগুটি ডিপার্টমেণ্টের ঐ ভদ্রলোকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যে, এখানে আমার কে কে আছে। আমি আত্মীয়দের সাথে আমার যুবতী মেয়ের কথাও বলি। তখন ঐ পশুরা বলে যে তোমার সেই ১৫-১৬ বছরের মেয়েকে এখনই এখানে নিয়ে আসা হচ্ছে এবং এদের সামনে তোমাকে তোমার মেয়ের সাথে ‘সহবাস’ করতে হবে। অস্বীকৃতি জানালে আমার উপর এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী অত্যাচার করে। শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে দরবিগলিত ধারায় রক্ত ঝরতে থাকে। সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানেই সকলে ছিলাম। যে আসত সে-ই মারত এবং কাফের লোক কো খতম করো বলে গাল দিত। এ সময় কয়েকজন দাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করে যে, তোমরা মুসলমান কি না এবং নামাজ পড় কিনা? হ্যাঁ-বাচক উত্তর দিলে তাদেরকে কলেমা পড়তে বলে। কলেমা পড়তে থাকলে তাদেরকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয় এবং বলে যে, 'তোম লোগ কাফের হ্যায়, তুম ঝুটা বলতা হ্যায়।'

 সন্ধ্যার পর একটি ঘরে সকলকে বসায় এবং শুকনো রুটি ও ডাল এনে দেয়। খাওয়ার পর মুসলমানেরা নামাজ পড়তে চাইলে তাদেরকে মসজিদে না যেতে দিয়ে সেখানেই নামাজ পড়তে নির্দেশ দেয়। নামাজ পড়া যেই শেষ হয়েছে, অমনি জনৈক কোয়ার্টার মাষ্টার বেত হাতে এসে প্রহার শুরু করে। তোম লোগ নামাজ পড়তা হ্যায়। তোম লোগ বাঙ্গালী মুসলামান, তোম লোগ কাফের হ্যায়।