পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/১৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৩৭
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড

 সেখান থেকে অতঃপর আর এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অনেকগুলো বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লোক বন্দি অবস্থায় ছিল। সেখানে দরজা খুলে সকলকে ঢুকিয়ে দেয়। সেখানে বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লোকদের মুখে জানতে পারি যে, তারা সীমান্তবর্তী এলাকায় ছিলেন। ডিউটি অন্যত্র দেয়া হবে নিয়ে এসে বন্দি করে। তারা সংখ্যায় প্রায় ৫০-৬০ জন ছিলেন। ঘণ্টাখানেক পর উল্লিখিত কোয়ার্টার মাষ্টার দরজা খুলে সিভিলিয়ানদের বেরিয়ে আসতে নির্ধেশ দেয় এবং বেরিয়ে আসলে অন্য আর একটি ছোট ঘরে নিয়ে যায়। ঘরের সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ ছিল এবং ঘরের ভিতর কোন আলো ছিল না। কেউ যেন না বসে এমন নির্দেশ দিয়ে সে চলে যায়। তার কিছুক্ষণ পর ঐ একই ব্যক্তি এক এক করে ঘরের বাইরে ডেকে নেয় এবং আমার প্রতি অকথ্য অত্যাচার করতে থাকে। যখন আমার পালা আসে তখন আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, শহরের কে কে বাংলাদেশের পতাকা তুলেছিল, কে কে মুজিব ত্রাণ ফাণ্ডে চাঁদা দিয়েছে এবং কে কে নেতা?

 পরদিন সকালে আমাদের দিয়ে একটি পুকুরের বাঁশ উঠিয়ে নেয়া হয় এবং মাঠের ঘাস পরিষ্কার করে নেয়া হয়। তারপর অপর একজন এসে আমাদেরকে বন্দি করতে নির্দেশ দেয়। তখন আমার পূর্বে ধৃত আমার বাবার খবর জানতে চাইলে তাদের সকলকে যে ঘরে আমার বাবা এবং স্থানীয় এমসিএ জিকরুল হকসহ ১৫-১৬ জন বন্দি ছিলেন সেখানে বন্দি করে রাখে।

 কিছুক্ষণ পরে মেজর জাভেদ এসে সকলকে একদিক থেকে ঐ ঘরেই প্রহার করে। ডাঃ জিকরুল হককে প্রহার করার সময় সে বলে 'ডঃ জিকরুল তোম বলতা হ্যায় মিলিটারী ফাঁকা ফায়ার করতা হ্যায়। তোম হিয়াসে মব লাগাতা হ্যায়? বানচোত, তোম সবকো গুলি কর দিয়ে গা। তারপর ক্যাপ্টেন বখতিয়ার লাল আসে এবং একই প্রক্রিয়ায় অত্যাচার করে।

 পরদিন সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন গুল এসে তার মাথার শিরোস্ত্রাণ খুলে তা দিয়ে সকলকে প্রহার করে। মারের চোটে কেউ চীৎকার করতে চাইলে সে বলতে চীৎকার মাৎ কারো। এদিন ডাক্তার সাহেবকে বেশী অত্যাচার করে ও অকথ্য এবং অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করে। তাকে লাথি দিয়ে বাইরে ফেলে দেয় এবং সেখানে তার প্রতি গুল ও অন্যান্য মিলিটারীর হৃদয়হীনভাবে অত্যাচার করে। এতে তার চশমা ভেঙ্গে যায়; মাথা ফেটে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। অতঃপর তার মাথা ব্যাঞ্জে করে লাথি মেরে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়।

 ডাক্তার সাহেব ঘরে ঢুকলে সকলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ডাক্তার সাহেব সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ওরা অত্যাচার করুক না। আর না হয় কাল দিন আসবে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।

 ১২ তারিখ সকালে সেণ্ট্রি এসে জানায় যে, আপনাদের যা খাবার খেয়ে নেবেন, আপনাদের আজ কোথাও যেতে হবে। ১২টার দিকে দরজা খুলে বাইরে বেরোলেই উল্লিখিত কোয়ার্টার মাষ্টার সকলকে একটি দুটি করে লাথি মেরে ট্রাকে উঠতে নির্দেশ দেয়। ট্রাকে উঠলে তিনজন করে একত্রে পেছনে শক্ত করে হাত বেঁধে দেয়। তিনটি ট্রাকে বেঙ্গল রেজিমেণ্টর লোকসহ প্রায় ১৫০ জনকে উঠায়। ট্রাক রংপুরের রাস্তা ধরে আস্তে আস্তে যাচ্ছিল। যাবার পথে পাহারারত সামরিক লোকেরা বেল্ট দিয়ে, রাইফেলের বাঁটি দিয়ে অথবা বুট দিয়ে খুচিঁয়ে অত্যাচার চালাতে থাকে। শেষাবধি রংপুর ক্যাণ্টনমেণ্টে নিয়ে যায়। সেখানে পৌঁছার পরই সকলের উপর অকথ্য অত্যাচার করে। তারপর অফিসার এসে নামের তালিকা বের করে সকলের নাম মিলিয়ে নেয়। তারপর রংপুর উপশহরের দিকে অফিসাররা জীপে যাত্রা করে এবং পিছনে পিছনে ট্রাকগুলোও যেতে থাকে। উপশহরের পাশে বালি তোলা খাদের কাছে নিয়ে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করায় এবং সেখানে প্রথমে বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লোকদের ৬ জন ৬জন করে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তারপর সিভিলিয়ানদের এক একজন করে পাশাপাশি একবারে ছয়জন করে দাঁড় করায়। তাদের সামনে খুব নিকটে ছয়জন বন্দুকধারী সিপাই থাকে এবং পাশে জোড়া লাগানো কালো প্যাণ্ট-শার্ট পরিহিত একজন সিপাই। দাঁড় করিয়ে দেয়া হলে ঐ কালো কাপড় পরিহিত লোক বলল ‘সিঙ্গল ফায়ার’ বলে রাইফেল উপরে তুলে গুলি করত আর গুলি কারার সাথে বলত ‘স্টার্ট ফায়ার’। সাথে সাথে উল্লিখিতি ছ'জন ছ’জনকে দাঁড় করানো হতো।