পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/১৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৩৮
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড

 আমি ও আমার ছোট ভাই কমলাপ্রসাদ ঐরূপ তৃতীয় গ্রুপে ছিলাম। আমরা নিজেদের কিছু সলাপরামর্শ করে গুলি করার পূর্বমুহূর্তেই ইচ্ছাকৃতভাবে পড়ে যাই। ফলে গুলি লক্ষ্যভেদ হয়ে আমার হিপে (উরুর উপরে) এবং আমার ছোট ভাইয়ের হাঁটুর উপরে উরুতে লাগে। আমরা মরার ভান করে পড়ে থাকি এবং সমস্ত লক্ষ্য করতে থাকি।

 এ হত্যাযজ্ঞের মাঝামাঝি সময়ে ডাঃ জিকরুল হককে একাই দাঁড় করায় এবং জিজ্ঞাসা করে যে, ‘এ্যাই তোমহারা জিন্দেগী আওর মউত কো স্যোয়াল হ্যায়। হাম জানতা হ্যায় তোমস্যে মুজিবরস্য ফোন মে বাত হোয়া।' তিনি উত্তর দিলেন আমি মরার সময় মিথ্যা কথা বলে গোনাহগার হব না। আর এ কথা বলার সাথে সাথে তাকে গুলি করে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পড়ে যান এবং বলেন ‘আল্লাহ তোমার এখানে বিচার নেই, বিচার কর।” এটাই তার শেষ কথা। শেষের দিকে স্থানীয় প্রভাবশালী ডাঃ শামশুল হককেও ঐ একা দাঁড় করিয়ে হত্যা করে।

 এ অবস্থায় সকলকে হত্যা করতে প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে অন্ধকার হয়ে যায়। এবং আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ও মেঘ ডাকতে থাকে। হত্যাপর্ব শেষ হলে সকল মৃত ব্যক্তিকে ৫-৭ জনে পা ধরে টেনে উল্লিখিত খাদে ফেলে দেয় এবং আর ১০-১২ জনে উপর থেকে মাটিচাপা দিচ্ছিল। সে সময় অনেকে জীবিত ছিল। তারা গগনবিদারী করুণ চীৎকার করে আর্তনাদ করছিল। কেউ বা শেষবারের মত এক গ্লাস পানি পান করতে চাইছিল। আবার কেউ বা এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার জন্য আর একটা গুলি ভিক্ষা করছিল। মাটি চাপা দিতে দিতে ভীষণ বৃষ্টি শুরু হয়। ফলে তারা আমার শরীরের অর্ধাংশ মাটি চাপা দিয়েই পরবর্তী সময়ে মাটি চাপা দেয়া হবে বলে চলে যায়।

 ওরা চলে যাবার পর আমি ঐ গর্ত থেকে একজনকে উঠে দৌড়ে পালাতে দেখি। সে সময় আমার ভাই উক্ত পলায়নরত ব্যাক্তিকে লক্ষ্য করে বলে যে মিঠু আমাকে বাঁচা। আমার কেউ নেই এখানে। কিন্তু ঐ ব্যাক্তি শুনতে না পেয়ে চলে যায়।

 এদিকে আমি যেখানে ছিলাম সেখান থেকে উঠবার চেষ্টা করছিলাম। আমার নড়াচড়াতে আমার দেহের উপর থেকে বেশ ক'টি লাশ গড়িয়ে পড়ে যায়। সে সময় আমার পাশেই এক বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লোক জীবিত ছিলেন। তার একটি হাত ছিল না। তিনি আমাকে পালিয়ে যেতে বলেন এবং অপর হাত দিয়ে আমার হাতের বাঁধন খুলে দেয়ার শেষ চেষ্ট করেন; কিন্তু তা পারেন না। কারণ তার হাত অবশ হয়ে যাওয়ায় তা সামনে আসেনি। আমি নিজে নিজে বহু চেষ্টা করে হাতের বাঁধন খুলে ফেলি এবং আমার ভাইকে সাথে করে নিয়ে গর্তের উপরে উঠতে চেষ্ট করি। উপরে ওঠার পর হঠাৎ পা পিছলে নিচে পড়ে যাই। গর্ভ থেকে আমি ভাইকে গ্রামে আশ্রয় নেবার নির্দেশ দেই।

 গর্ত থেকে উঠে আমার ভাইকে আর পাই না। অতি কষ্টে কিছু দূরের গ্রাম একটি বাড়ীতে আশ্রয় নেই। সেখানে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে আরও দূরে এক গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেই। উক্ত গ্রামের জনৈক মহিউদ্দিনের আন্তরিক সেবা-যত্নে কিছুটা সুস্থ হই। তারপর সেখান থেকে উক্ত ব্যাক্তির সাহায্যে প্রথমে তার এক আত্মীয়ের বাড়ী এবং পরবর্তীকালে জলঢাকা (নীলফামারী) যাই এবং সেখান থেকে মুক্তিবাহিনীর গাড়িতে করে ভারতের জলপাইগুড়ি পৌঁছি।

 অপর পক্ষে আমার ভাই উক্ত ব্যাক্তির অক্লান্ত সেবা-যত্নের ফলে সুস্থ হয়ে ওঠে। রংপুর হাসপাতালে চিকিৎসার পর তাকেও ভারতে পাঠানো হয়।

 এখানে উল্লেখযোগ্য যে, উক্ত গর্ত থেকে সেদিন মাত্র চার ব্যক্তি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল।

স্বাক্ষর/-
নারায়ণ প্রসাদ