পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sbrど বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড ી ૨૭૦ | শ্ৰী বিমল কান্তি গুহ গ্রাম- নাপোড়া থানা-বাঁশখালী জেলা- চট্টগ্রাম ৯ই অক্টোবর পাক হানাদার বাহিনী দ্বিতীয়বার বাঁশখালীতে আসে এবং গুনাগরীতে একটি আস্তানা করে। ঐ দিন তারা লোকজনের উপর কোন প্রকার অত্যাচার করে নাই। কিন্তু আমাদের নাপোড়া গ্রামের লোকরা পাঞ্জাবী আসার খবর পেয়ে স্ত্রী পুত্র আত্মীয় স্বজন সবাইকে নিয়ে পাহাড়ে চলে যায় এবং সন্ধ্যার পূর্বে বাড়ীতে চলে আসে। ১০ই অক্টোবর তারিখে ভোর পাঁচটার সময় পাক বাহিনী আমাদের গ্রামটার পূর্ব জংগলের দিক হতে আক্রমণ করে। আমাদের গ্রামের লোকরা আর জংগলের দিকে পালাতে পারে নাই। নিরীহ নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে। আমি যখন আমার পরিবার পরিজন নিয়ে জংগলের দিকে পালাচ্ছিলাম তখন একটা গুলি আমার হাতের ব্যাগের মধ্যে পড়ে এবং ব্যাগটা ছিড়ে হাত হতে পড়ে যায়। আমার সামনে একজন মহিলা দুগ্ধপোষ্য একজন শিশুসহ গুলিবিদ্ধ হয়, কিন্তু দূর গিয়ে দেখি আরও তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। স্ত্রী পুত্র আত্মীয়স্বজন কে কোথায় জানি না, দূর পাহাড়ে চলে যাই। গ্রাম তখন জুলছে, লুটপাট চলছে, ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাহাড় থেকে দেখা যাচ্ছে। আমার মত অনেকেই পাহাড়ের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। সকলের মুখে হতাশার ছবি। সবাই বলাবলি করছে, মা, বাপ, ভাই, সবাই মারা গেলো, অবশিষ্ট কেউ নাই, খাওয়া দাওয়া নাই, অনেক লোক একত্রিত হয়েছি। গ্রামের খবরাখরব নেওয়ার চেষ্টা করছি। কেউ কেউ তাদের ছেলে মেয়ে স্ত্রীকে জংগলে খোঁজ করছে, আমিও আমার স্ত্রী, একজন ছেলে ও এক বৎসরের ভাগিনীকে খোঁজ করতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেলো না। অনেকে স্বান্তনা দিচ্ছে হয়। দু’দিন ধরে তারা কিছু খায় নাই। তাদেরকে দেখে আমার ভীষণ কান্না এসে পড়লো, স্ত্রী-পুত্র নিয়ে আমি বেঁচে আছি দেখে আনন্দে কেঁদে উঠলাম, আমার ছেলেটিও কাঁদতে লাগলো। তারপর আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামে আসার প্রস্ততি নিচ্ছি। গ্রামে এসে দেখি বেশ কিছু লোক আছে। বর্বর পাক বাহিনীর হাতে মারা গেছে আমার বাড়ীর পাশের ৫জন লোক। কে কোথায় কিভাবে মারা গেছে তা কেউ ঠিক করে বলতে পারছে না। যেদিন আমরা নাপোড়া বাড়ীতে আসলাম সেদিন কয়েকজন পাঞ্জাবী সেনা বাহিনী দক্ষিণ হতে জনাব ঢুকলো। আমি তখন বাইরে ছিলাম। দূর থেকে বর্বর হানাদারদের দেখেছিলাম। আমার স্ত্রীও বাইরে ছিল, তাকে ইশারা করে আমি নাপোড়া বাড়ীর পাশ দিয়ে চলে গেলাম। আমার স্ত্রী অন্য দিক দিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেলো। পর মুহুর্তেই আমার বাড়ীতে দুৰ্বত্তরা ঢুকে পড়ে অন্যান্য যারা ছিল তাদের উপর ভীষণ মারধোর করে। আমার ভাগনী বাসন্তী রাণীর কাছে লুকায়িত বিষ ছিল। তার সতীত্ব রক্ষার জন্য কোন উপায় না দেখে সে বিষ পান করলো। দু-ঘন্টা মধ্যে সে প্রাণ ত্যাগ করে। আমার ভাগনী ২য় বিভাগে মেট্রিক পাশ করেছিল। রাত্রিতে এসে আমার বাগণীকে মৃত অবস্থায় দেখে চোখের জল রাখতে পারলাম না। রাত্রিতে গ্রামের দুই একজন লোককে ডেকে বাসন্তী রাণীকে কবর দেই। এটা ছিল আমাদের গ্রামের কাহিনী। স্বাক্ষর/শ্ৰী বিমল কান্তি গুহ