পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড
৩১৯

না। আটকাবস্থায় পড়িয়া প্রথমেই আমার স্মরণ পড়ে আমার সর্বকনিষ্ঠা মেয়ে দুলালী পারভিনের কথা। তারপর একে এক প্রতিটি সন্তান ও স্ত্রীর কথা। ক্রমে জীবনের স্মরনীয় মুহূর্তের বিভিন্ন প্রতিচ্ছবি আমার চোখের সামনে সিনেমার মত ভাসিয়া আসিতে থাকে।

 আরও দুইজন ভদ্র লোককে সেখানে কয়েদি হিসেবে বন্দি দেখিলাম। একজনকে ভাল করিয়াই জানি, আর একজন আমার অপরিচিত। সন্ধ্যার লগ্নে আমাদের জন্য আটার রুটি ও ডাল দিয়া গেল। সাথের ঐ দুই ভদ্রলোক কয়েকদিন হইতে অভ্যস্থ বলিয়া ডাল-রুটি খাইল, আমার দ্বারা কিছুতেই সম্ভবপর হইল না। দুদিন পায়ে হাঁটিয়া এবং তৃতীয় দিনে আটকা অবস্থায় আমার শারীরিক অবস্থা একেবারে শক্তিহীন হইয়া পড়ে।

 রাত্র অনুমান আটটার দিকে দুজন সৈনিক আমাকে অন্য কক্ষে নিয়া যায় এবং আবার কেন চাকুরীতে যোগদান করি নাই, মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করিয়াছি, কয়েকজন অবাঙালী হত্যা করিয়াছি ইত্যাদি প্রশ্ন করিয়া শাসাইতে আরম্ভ করে। জিজ্ঞাসাবাদ যাহারা করিতেছিল তাহাদেরকে জল্লাদ বলিলেও যথেষ্ট হইবার নহে। লাঠি দ্বারা ধাক্কা দেয়, সত্য কথা না বলিলে জীবনে এখনই শেষ করিয়া দিবে বলিয়া হুঁশিয়ার করিতে থাকে। তাহাদের মনমত কোন কথাই আমার কাছ থেকে পাইতেছে না মনে করিয়া তাহারা আমার প্রতি ভীষণ চটিয়া যায়। হাত দুই লম্বা লাঠি দ্বারা আমাকে বেদম প্রহার করিতে থাকে। জীবনে কোন কারণে কোন অবস্থায় এমন শারীরিক মানসিক নির্যাতন সহ্য করিতে হয় নাই। তাহাদের মারের চোটে আমি কখন কি অবস্থায় সংজ্ঞা হারাইয়া ফেলি বলিতে পারি না। ভোর বেলা দেখি আমি প্রথম যে রুমে ঢুকি সেখানেই শায়িত। মার খাওয়া জায়গাগুলো কালো ও ফুলিয়া রহিয়াছে, হাত দিয়া ছুঁইতে পারি না। রাত্রে যে রুমে নিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল তাহার চতুর্দিকের দেওয়ালে রক্তের দাগে ঐ রুমটা যে জল্লাদের নির্যাতন কক্ষ তা বুঝিতে আমার বাকী ছিল না। প্রত্যুষে তালা খুলিয়া আমাদেরকে পায়খানাপ্রসাব করার জন্য নিকটস্থ খালের পাড়ে নিয়া গেল। সেখানে পৌঁছিয়া আমার ৮-১০ জন কয়েদি হইলাম, ইহাদের মধ্যে অনেকেই আমার মত অচল প্রায়, কথাবার্তা বলিতে পারে না। কথা বলা ও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। এক সাথে সকলকে কোন পর্দার ব্যবস্থা ছাড়া লাইন করিয়া বসাইয়া দিল পায়খানা করিতে। কে পায়খানা করিল জানি না। আমার তো পায়খানা-প্রসাব কিছুই হইল না। তা ছাড়া আমি দুদিনের উপবাসী। ২-৩ মিনিটের মধ্যে পায়খানা-প্রসাব ও খালে পানি খরচ করিয়া হাত মুখ ধুইয়া আসিতে হয়। বন্দুকধারী সৈনিক ও হাওয়ালদার দুইদিকে দণ্ডায়মান।

 আবার আসিয়া যার যার রুমে স্থান লইতে হইল। একটা পুরি ও এক কাপ চা খাইতে দেওয়া হইল। দুপুরে আটার রুটি আর ডাইল। শরীরে জ্বর, কিছুই খাইতে পারি না। মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবার পরিজনদের কথাই মনে পড়িত। বিপদে পড়িয়া সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামই আহার-বিহারে সম্বল করিয়া লইলাম। বিকালে আবার ডাইল-ত্রুটি দিল। ভাতের নাকি ব্যবস্থা নাই, তাই ভাতের কথা উচ্চারণ করিবার সাহসও হইল না।

 আমাদিগকে যে রুমে রাখিল তাহার দুদিকে বন্দুকধারী সৈনিকরা পোষাক ও অস্ত্রশস্ত্র লইয়া শুইয়া থাকে। আমাদের দিকে তাহারা প্রকারান্তরে খুব খেয়াল করিত। আমরা কি বলি না বলি তাহা শুনিতে চেষ্টা করিত। জানালায় এক প্রকার কালো তার জড়ানো ছিল, তাহাতে আমাদের মধ্যে হইতে যেন তাহারা টেপ করিয়া রাখিয়াছে। জনমানবশূণ্য এলাকায় আমার ছিলাম, রোজই বিভিন্ন চেহারার সৈনিক আসিয়া তালা খুলিয়া দিলে কয়েদি হিসাবে আমাদের সহিত ঠাট্টা-চাতুরী করিত। কোথায় তোমাদের শেখ সাহেব, কোথায় বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি বলিয়া ব্যঙ্গ করিত। আর লম্বা লাঠি দ্বারা গুঁতা দিয়া জনোয়ার ইত্যাদি বলিত। কেউ কেউ ধীরস্থির হইয়া আমদিগকে হিন্দুর গোলাম, হিন্দুর পয়দা বলিয়া গালি দিত।

 একদিন আমাদের সাথের একজন লোক বেলা প্রায় ১১টার সময় পায়খানা করার জন্য অস্থিরভাবে প্রহরারত সৈনিককে মিনতি করিত লাগিল। এমন সময় একজন সুবেদার মেজর আসিল। কর্মরত সৈনিক লোকটার পায়খানার কথা জানায়। তাদের ভাষায়- তারা কি বলিল জানি না। তাহাকে ২-৩ জনে পায়খানা করাইবার