পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

{{rh||বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড|}৩৩২}

আন্দোলনের শিকার হয়েই হোক, ইকবাল হল তাদের চিরদিনের একটা নিরাপদ আশ্রম। বলতে গেলে তাদের জন্য এটা সুরক্ষিত দূর্গ।

 কিন্তু এবার সে দূর্গ তাদের রক্ষা করতে পারলো না। যেমনি দলে দলে লাফ দিয়ে পাঁচিল ডিঙ্গিয়েছিল তেমনি দলে দলেই মুখ থুবড়ে পড়লো স্বদেশের পবিত্র মাটিতে পাক হানাদারদের বুলেট খেয়ে। এই রেল সড়কের বস্তি সংলগ্ন ইকবাল হলের পিছন দিকটার হলের গৃহ শিক্ষকদের কোয়ার্টার। জনৈক গৃহ শিক্ষক পড়ার টেবিলে থিসিসের সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন।

 বই আর শিক্ষা অঙ্গই তাঁর জগৎ। এর বাইরে যা ঘটে তার আভাস ইঙ্গিত পান ঘটনার পর। প্রত্যক্ষভাবে বাইরের কিছুরই সাথে তিনি জড়িত নন, তাই এই কালরাতের বিভীষিকা সম্পর্কে কোনরূপ পূর্ব ধারনাই তাঁর ছিল না। রাত ৮টার দিকে ডাকসুর সহসভাপতি আবদুর রব তাঁর ঘরে রাখার জন্য একটা ট্রাঙ্ক পাঠিয়েছিলেন। তখন গৃহশিক্ষক অধ্যাপক চৌধুরী মনে করেছিলেন একটা কিছু হবে বোধ হয় আজ রাতে। এর বেশী আর ভাবনাই তাঁর আসেনি। ইতিমধ্যে কয়েকজন শিক্ষক চলে গিয়েছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। কিন্তু অনেকেই যাননি। হলে যতক্ষণ ছাত্ররা রয়েছে ততক্ষণ তাঁদের যাওয়া কি শোভা পায়? তাঁদের প্রতি দায়িত্ব রয়েছে না শিক্ষকদের। এই দায়িত্ব বোধই ধরে রাখে অধ্যাপক চৌধুরীকে সপরিবারে তাঁর দোতালার কোয়ার্টারে।

 বস্তিবাসীদের আর্তনাদ চিৎকার আর মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরানি শুনে ধ্যান ভাঙ্গলো চৌধুরী সাহেবের। পড়ার টেবিল থেকে উঠে জানালা দিয়ে দেখতে চাইলেন কি ব্যাপার। আঁতকে উঠলেন অধ্যাপক সাহেব। কি সর্বনাশ, এ যে বিভাষিকা! ঢাকা নগরী যেন এক রাক্ষসপুরী। চলছে পিশাচ দেবতার অর্চনা।

 রাক্ষসদের চলছে মহাসমারোহে নরমাংস ভোজোৎসব। সে হিংস্রাতার এক নজীরবিহীন ইতিহাস। অধ্যাপক চৌধুরী যেদিকে তাকালেন শুধু আগুন আর গোলাগুলির বিরামহীন ভয়াল গর্জন।

 ২৫শে মার্চের বিভীষিকাময় কাল রাতের অবসান হলো। কিন্তু কাক ডাকলো না সম্মিলিত স্বরে, পাখি কলকুঞ্জন দিগন্ত মুখরিত করে ২৬শের প্রভাতকে স্বাগত জানালো না-তবু ভোর হলো। ভোর হলো এক নিস্তব্ধ শোকে মুহ্যমান শ্মশান নগরীতে এক মৃত্যুপুরীতে। বস্তুতঃ বিভীষিকাময়তার অবসান হলো না। বরঞ্চ বাংলাদেশে ইতিহাসের নজীরবিহীন হত্যাযজ্ঞ, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, ধ্বংস আর অত্যাচার নিপীড়নের বিভীষিকাময় অধ্যায়ের এখান থেকেই শুরু। গুলিগোলা থেমে গেছে ইকবাল হল এলাকায়।

 কিন্তু সান্ধ্য আইন জারী করেছে হানাদাররা সমস্তদিন ধরে। কারণ হত্যাযজ্ঞ যা চালিয়েছে তা সবটা জানাতে চায়না বিশ্ববাসীকে। তবু ভোর হবার সাথে সাথে ফাঁক বুঝে শোকে মুহ্যমান হাজার হাজার নরনারী জীবন বাঁচাবার তাগিদে ছুটছে শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। ইকবাল হলে ও আশপাশে যারা তখনো বেঁছেছিল তারাও জীবনের তাগিদে বেরুচ্ছে ফাঁকার দিকে। রাতে হানাদাররা হলের প্রতিটি ঘরে তালা ভেঙ্গে আসবাব বিছানাপত্র পুড়িয়েছে, মূল্যবান জিনিষপত্র যা চোখে পড়েছে সব লুটে নিয়ে গেছে আর যাকে পেয়েছে সামনে তাকে হত্যা করেছে নির্মমভাবে।

 এর ফাঁকে ফাঁকে দু'চারজন বেঁচে গেছে নানান কৌশল করে। যেমন বেঁচে গেছে তারেক, জিনাত আলী, রউফ, মোয়াজ্জেম, গ্যারেজের ছাদে আশ্রয় নিয়ে। বেঁচে গেছে আর একটি ছেলে আর হলের একটা কক্ষে থেকেও। সে লেপ জড়িয়ে নিঃসাড় দাঁড়িয়ে ছিল দেয়ালে ঠেসান দিয়ে। হানাদাররা তখন খুনের নেশায় মাতাল তাই অতো খুঁটিয়ে দেখার ফুসরত তাদের ছিল না। বেঁচে গেছে কয়েকজন হলের পেছনে সাধারণ কর্মচারীদের কোয়ার্টারে আত্মগোপন করে। রেল সড়কের বস্তির বাসিন্দা চম্পার মা, তার ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে আশ্রয়