পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড
৩৪৬

মাঠ ও সলিমুল্লাহ হলের যে অংশ দেখা যাচ্ছিল সেখানে তাণ্ডবলীলা দেখতে লাগলাম আর কখন এসে আমাকে ধরে নিয়ে গুলি করবে সেই মুহূর্ত গুনতে লাগলাম। এক সময় দেখা গেলো সলিমুল্লাহ হলের দিকে আগুন। সলিমুল্লাহ হলের দক্ষিণ পূর্ব কোণের বড় একটি গাছেও আগুন জ্বলতে দেখলাম। মাঝে মাঝে উত্তর বাড়ীর পশ্চিম দিকের আকাশ লাল হয়ে উঠছিল। আর বুঝতে পারছিলাম ঐ দিকের কোথাও আগুন লাগিয়েছে পাক সেনারা। বাইরের মতো হলের মধ্যেও চলল সমস্ত রাত গোলাগুলি আর আগুন।

 এক সময় কোন একদিকে আজানের শব্দ শুনতে পেলাম। কিছুক্ষণের মধ্য আরো কয়েকদিকে আজান শোনা গেল। মনে হলো আজানের এমন করুণ সুর এত বিষণ্ন সুর আর কোনো দিন শুনিনি। গোলাগুলির শব্দ হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো কিন্তু বন্ধ ছিল মুহূর্তের জন্য মাত্র। আবার চলল গোলাগুলি পুরোদমে। ভোরের দিকে মাইকে কারফিউ জারির ঘোষণা শুনলাম। তখন ভাবলাম বেলা হলে বোধ হয় এমন নির্বিচারে আর মারবে না। কিন্তু একটু ফর্সা হয়ে যেতেই দেখা গেলো এখানে সেখানে পালিয়ে থাকা ছাত্রদের ধরে এনে গুলি করছে। যেন দেখতে না পায় আমাকে এভাবেই মাথা নিচু করে লেট্রিনের মধ্য বসে রইলাম।

 বেলা হল। এক সময় আমার কাছাকাছি বারান্দায় অনেকের কথা শুনতে পেলাম। ছাত্ররা কথা বলছে তা নিশ্চিত হয়ে আমি লেট্রিনের দরজা খুলে বেরুলাম। বেরিয়ে দেখি সিঁড়ি মাথায় মেশিন গান তাক করে মিলিটারী দাঁড়িয়ে আছে আর কয়েকজন ছাত্র একটি লাশ ধরাধরি করে নামাবার চেষ্টা করছে। রাতে আমার মাথার কাছে দেওয়ালের ওপাশে যে গোঙ্গাচ্ছিল এটা তারই লাশ। এবং সে আর কেউ নয়, আমাদের হলের দারোয়ান, সবার প্রিয় প্রিয়নাথ দা। তাঁকে দিয়ে মেশিনগানের মুখে সব পথ দেখে নিয়ে নামার মুহূর্তে এখানে গুলি করে রেখে গেছে। আমিও আর নিষ্কৃতি পেলাম না।

 আমাকেও ধরতে হলো লাশ। তিন তলা থেকে দোতলা, সেখান থেকে একতলা দক্ষিণ দিকের ভাঙা গেইট দিয়ে ব্যাংকের (এখন যেটা সুধীরের কেণ্টিন ওটা ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান) উত্তর পাশে নিয়ে রাখলাম। আরো লাশ জড়ো করা হলো সেখানে। ওখানে আমাদের বসার নির্দেশ দিল একজন পাক সেনা।

 তখন ছিলাম আমরা কয়েকজন ছাত্র, কয়েকজন মালী, লণ্ড্রির কয়েকজন দারোয়ান গয়ানাথের দুই ছেলে শংকর ও তার বড় ভাই, আর সবাই ছিল সুইপার। লাশগুলো পাশ ঘিরে আমরা সবাই বসেছিলাম। সুইপারগুলো তাদের ভাষায় মিলিটারীদের কাছে অনুরোধ করছিল ওদের ছেড়ে দেয়ার জন্য। বলছিল ওরা বাঙালী নয়। সুতুরাং ওদের কি দোষ? একজন মিলিটারী ওদের আলাদা হয়ে বসতে বললো আমাদের কাছ থেকে। ওদের নিয়ে কয়েকজন মিলিটারী সোজা উত্তর বাড়ী মাঠে চলে গেলো। ভাবলাম ওদের ছেড়ে দেবে। আমাদের আবার ঐ লাশগুলো বহন করতে আদেশ দিল। লাশগুলি নিয়ে এ্যাসেমব্লির সামনের রাস্তা দিয়ে সোজা পূর্ব দিকের গেটের বাইরে চলে গেলাম। গেটের বাইরে দক্ষিণ পাশে একটি বড় গাছের গোড়ায় জড়ো করলাম লাশগুলো। এই সময় আমাদের সাথে প্রায় সমানসংখ্যক মিলিটারী ছিল। এবং তারা সবাই ছিল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। ওখানে যেয়ে মিলিটারীরা দাঁড়ালো অনেকক্ষণ। একজন সিগারেট বের করে দিল সবাইকে। আমাদের কেউ বসে, কেউ শুয়ে থাকলো। আমিও কাত হয়ে ছিলাম গাছের শিকড়ের উপর। এইখানে পাক সেনারা আমাদের উদ্দেশ্যে বিশ্রী ও অকথ্য ভাষায় ক্রমাগত গালাগালি করছিল। যতোটা বুঝতে পারছিলাম তাতে বুঝলাম, শালা! বাংলাদেশ স্বাধীন করিয়ে দেবো; বল শালারা জয় বাংলা। শেখ মুজিবকেও বাংলাদেশ স্বাধীন করিয়ে দেবো। আরো নানা অশ্লীল গালাগালি দিচ্ছিলো। এ সময় একটি গাড়ীর বহর রেস কোর্সের দিক থেকে এসে ওখানে থামল। আমাদের সাথের মিলিটারীর একজন সামনের একটি জীপের কাছে গেলো। তাকে কিছু নির্দেশ দেয়া হলো বুঝলাম।